ডলের জীবন ঠিক যেন সিনেমা...

ডলের জীবন ঠিক যেন সিনেমা...

Friday November 27, 2015,

4 min Read

এই অদম্য নারীর জীবনে প্রেম, মান-অভিমান, সাহসী লড়াই, জেদ, অ্যাকশন, থ্রিল, ক্লাইমেক্স এবং হ্যাপি এন্ডিং। না, এখনই এন্ডিং বলা ঠিক নয়। কেননা জীবনের সৌন্দর্য সেটা সিনেমা না হয়ে ওঠার মধ্যেই। আরও দীর্ঘ পথ চলতে হবে ডলকে। আরও অসংখ্য উত্থান পতন... আরও ক্লাইমেক্স হয়তো অপেক্ষা করছে জীবনে। সাফল্যের সপ্তম স্বর্গ পর্যন্ত পৌঁছনর স্বপ্ন দেখেন মেয়েটি। আসল নাম সঙ্ঘমিত্রা সাউ। সকলেই ডল বলেই ডাকে। বয়স এখনও তিরিশের কোঠাও ছোঁয়নি। তবু তৈরি করে ফেলেছেন নিজের একটা সাম্রাজ্য। দেখলে বোঝার উপায় নেই, ছোটখাট গড়নের হাসিখুশি মিষ্টি মেয়েটার জীবনে এই বয়সেই কত ঝড় বয়ে গিয়েছে। সেই ঝড় তাঁকে শিখিয়েছে, কীভাবে অস্তিত্বের লড়াইয়ে মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে হয়।

image


যাদবপুরে এখন যেখানে সাউথসিটি মল, তার পাশেই বাবা শ্রীপতি সাউয়ের ছোট্ট টেলারিং শপ, সেই ৭৮ সাল থেকে। দোকানের নাম স্টাইলিশ। ছোট মেয়ে ডল যখন টালিগঞ্জ গার্লস স্কুলে একাদশ শ্রেণিতে পড়তেন সেই সময় হঠাৎ শ্রীপতি অসুস্থ হয়ে পড়েন। পড়া ছেড়ে বাবার ব্যবসার হাল ধরতে বাধ্য হন আঠারো না পেরোন ছোট্ট এই মেয়ে। এরই মধ্যে প্রেম। বাড়িতে কেউ মেনে নেয়নি। তাই পরিবারের পছন্দ করা পাত্রের সঙ্গেই বিয়ে করতে বাধ্য হন। দিঘার রামনগরে শ্বশুরবাড়ি। স্বামীর সংসার সুখের হল না। ডলের আসল লড়াইটা শুরু হল এখান থেকেই। ক্লাইম্যাক্সে ভরা হাজার এপিসোডের সিরিয়ালকেও হার মানিয়ে দিল সেই লড়াই। আজ আড়ি তো কাল ভাব। রীতিমত শ্বশুরবাড়ির রোলার কোস্টার। পণে গাড়ি দিতে না পারায়, মেয়ের উপর শ্বশুরবাড়ির অকথ্য অত্যাচার দিন দিন বাড়ল। শহুরে পরিবেশে বড় হওয়া ডল গরুর স্নান-খাওয়ানো থেকে মন মন ধান মাড়াই, তিন বেলার রান্না, সব একা হাতে সামলেও বাড়ির কারও মন রাখতে পারলেন না। মারধর তো ছিলই, প্রথম সন্তান পেটে আসার আড়াই মাসে সিঁড়ি থেকে ধাক্কা মেরে বউমাকে ফেলে দিলেন শ্বাশুড়ি। সেবার আর মা হওয়া হল না। মুখ বুজে সব সহ্য করে দ্বিতীয়বারও প্রায় মৃত্যুমুখ থেকে গর্ভের পুত্র সন্তানকে বাঁচিয়ে এনে পৃথিবীর আলো দেখালেন ডল। অত্যাচারের মাত্রা বাড়তে থাকায় এবার ছাড়তেই হল শ্বশুরবাড়ি। সঙ্গে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন একমাত্র সম্বল তাঁর ছেলেকে।

এবার সেকেন্ড এপিসোড। এরইমধ্যে খড়গপুরের কোশিয়ারি হাইস্কুল থেকে এইচএস পাশ করেছেন। শ্বশুরবাড়ি ফেরৎ ডল একরকম মুখ লুকিয়ে থাকতেন লজ্জায়। যাদবপুরে এক আত্মীয়র কম্পিউটার সেন্টারে কাজ নেন। সেখান থেকে বাবা শ্রীপতি প্রায় জোর করে নিজের টেলারিং শপে বসিয়ে দেন। হাতে ধরে কাজ শেখান। এখান থেকে ডলের উত্থানের গল্প শুরু। মেয়ের ডিজাইনিং, কাজের নেশা, একাগ্রতা আর অমায়িক ব্যবহারই ইউএসপি হয়ে ওঠে শ্রীপতিবাবুর এক চিলতে ‘স্টাইলিশ’এর। আগের থেকে গ্রাহকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে আয়ও। একটা থেকে দুটো দোকান, স্টাইলিশ থেকে নিউ স্টাইলিশ অ্যান্ড বুটিক, তিনটে কারখানা, ৩৮ জন কর্মী, উৎসবে-পার্বণে-বিয়ের মরশুমে সেই সংখ্যা দ্বিগুন ছাড়ায়-সব মিলিয়ে এখন কোটি টাকার ডিজাইনিং সাম্রাজ্য ডলের। ব্যবসার ফাঁকে একসময় ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট থেকে ফ্যাশন ডিজাইনিং এ ডিপ্লোমা করে নেন। এর মাঝেও পারিবারিক এবং স্বামী-শ্বশুরবাড়ি নিয়ে ঝামেলাও চলছিলই। সে প্রসঙ্গ আর নাই বা এল গল্পের এই ‘ফিলগুড’ অংশে এসে। রূপকথার মতো সাফল্যের এই ধাপে এসে সেই দিনগুলির কথা মনে করতে চান না ডল নিজেও।

প্রথম ব্রেক দেন টলি পাড়ার নামী অভিনেত্রী মৌমিতা গুপ্ত। ডলের করা মৌমিতার ব্লাউজের ডিজাইন মনে ধরে আরেক অভিনেত্রী পায়েল দে-র। পায়েলের বিয়ের ৪৭টি ব্লাউজ ৪৭ রকম ডিজাইনে বানিয়ে দিয়েছিলেন নিউ স্টাইলিশ টেলরর্স অ্যান্ড বুটিকের মালকিন। মাথার ওপর অবশ্যই ছাতার মতো ছিলেন বাবা। তারপর থেকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। আলো, আঁচল-জনপ্রিয় টেলি সিরিয়ালের কস্টিউম ডিজাইন থেকে ভেঙ্কটেশের মতো নামী প্রডাকশন হাউসগুলির সঙ্গে কাজ করছেন। স্টাইলিশের সামনে ঘিঞ্জি রাস্তায় টালিউডের অভিনেত্রী স্বস্তিকা, রাইমা, ঋতুপর্ণা, অপরাজিতা আঢ্যদের গাড়ির লাইন লেগেই আছে। পাঞ্জাবী, কুর্তা করাতে আসেন অভিনেতা সঞ্জীত, অর্ণব, দেবরাজরা। এককথায় টলি পাড়ায় ডলি এখন এক নামে পরিচিত। আরও আছে। ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়, আইএমআই, নিট, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের গাউনের ডিজাইন এবং সেগুলি তৈরি করে দেয় স্টাইলিশ। কারখানায় প্রায় ২৪ ঘণ্টা কাজ হচ্ছে। নিজের কারিগরদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ডল। ‘ওদের সুখে দুখে পাশে থাকার চেষ্টা করি। আমি যেমন আপন করে নিয়েছি, ওরাও আমাকে পর ভাবে না’, বলেন ডল। অসুবিধা একটাই। মাঝে মাঝেই বিনা নোটিসে ছুটি। তখনই বিনা মেঘে বজ্রপাত হওয়ার জোগাড় হয় তরুণ উদ্যোক্তার। ‘কারণ কারিগরদের সবাই মিলে হাত না লাগালে দিনে প্রায় দুহাজার পিস সেলাই বের করা অসম্ভব হয়ে পড়ে’, বলেন ডল।

তিনি জানান, ‘যে বিল্ডংয়ের তলায় ডলদের দুটি দোকান রয়েছে সেটি প্রমোটরকে দিয়ে একটা বড় ফ্লোর নিয়ে নেওয়ার ইচ্ছে আছে। সেইমতো বিল্ডিংয়ের মালিকের সঙ্গে কথাও হয়ে রয়েছে। ওই ফ্লোরেই আমার ড্রিম প্রজেক্ট, একটা বড় ডিজাইনিং শপ খুলব’। যে গাড়ির জন্য শ্বশুরবাড়ি ছাড়তে হয়েছিল সেখানে ডলির গ্যারেজে এখন অডি, হোন্ডাসিটি, ওয়াগনারের ভিড়। এই গাড়িগুলিই আবার ভাড়ায় যায় বিভিন্ন শুটিং-এ। এই দিকটাকেও ব্যবসার একটা অংশ হিসেবে দেখেন ডল।

শুধু নিজের ব্যবসা বাড়ানো নিয়ে ভাবেন না। যে আর্থিক পরিস্থিতির মধ্যে বড় হয়েছেন, কখনও ইচ্ছে করলেও বড় বড় মলে ঢোকার রেস্ত ছিল না। সেই নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির কথা মাথায় রেখে একটা মল তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার রাজপুরে ডলের বাবার একটা বাড়ি আছে। সেই জায়গাতেই মল গড়বেন বলে ঠিক করে রেখেছেন।

ছেলের বয়স এখন পাঁচ। পুরনো দিনগুলির দিকে ফিরে তাকানোর ইচ্ছে বা সময় কোনওটাই আক্ষরিক অর্থে নেই ডলের। শুধু এগিয়ে যেতে চান। ছেলেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন। আর স্বপ্ন দেখেন, ফ্যাশনের আকাশে উজ্জ্বল তারা হয়ে জ্বলার।