বছর দশ-পনেরো আগেও অন্যের করুণায় বেঁচে থাকতে হত। কাপড়ের ওপর আর্ট পেপার বসিয়ে তাতে নানারকম ছবি এঁকেও কদর ছিল না। বিভিন্ন সরকারি মেলা ও প্রদর্শনীতে সেই শিল্পকর্ম দেখানোর সুযোগ পাওয়াতে এক লহমায় বদলে যায় পটশিল্পীদের জীবন। এখন আর তাঁরা পিংলার নয়াগ্রামে আটকে নেই। আজ দিল্লি, কাল প্যারিস তো পরশু লন্ডন। এমন রুটিনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন শিল্পীরা। দেশ-বিদেশের নানা প্রদর্শনীতে গিয়ে বাংলার অহঙ্কার তুলে ধরেন তাঁরা। প্রযুক্তি ও আধুনিক চিন্তাভাবনার মোড়কে পশ্চিম মেদিনীপুরের এই হস্তশিল্পে এখন জোয়ার এসেছে।
সকাল হলে ঝোলা নিয়ে বেড়িয়ে পড়তেন শিল্পীরা। ঝোলায় থাকত পটের ওপর আঁকা নানা রকম চিত্র। পিংলার নয়াগ্রাম থেকে বেরিয়ে তাঁদের গন্তব্য হত আশেপাশের গড়বেতা, মেদিনীপুর শহর, খড়গপুর বা জামবনির মতো এলাকা। কারও বাড়িতে ঢুকে শিল্পীরা ঝোলা থেকে বার করতেন চাঁদ সদাগরের বেহুলা-লক্ষ্মীন্দর, কিংবা চণ্ডীমঙ্গল বা সাবিত্রী সত্যবানের মতো পুরাণ কাহিনি নিয়ে নিজেদের আঁকা পটের ছবি। আর সেই ছবি দেখিয়ে গান গাইতেন শিল্পীরা। গানের পর শ্রোতারা যা দিতেন তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হত। এর ফলে কোনওদিন আধপেটা কিংবা প্রায় না খেয়েই থাকতে হত শিল্পীদের। ৯০ এর দশকের শেষের দিকেও পিংলার নয়া এলাকায় পটশিল্পীদের ছিল এটাই রোজনামচা। রাজ্যের একমাত্র পটশিল্পীদের গ্রাম হলেও সেভাবে কারও নজর ছিল না।
গেঁয়ো যোগি আর এভাবে কতদিন ভিখ পায়। হয়েছিলও তাই। একসময় পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার নানা প্রান্ত চষে বেড়ালেও পট এঁকে ভিক্ষা করে আর কিছুতেই চলছিল না শিল্পীদের। এই শতাব্দীর শুরুতে অবশেষে সরকারিভাবে শিল্পীদের জন্য কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়। রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় সরকারি উদ্যোগে হস্তশিল্প মেলায় অংশ নেওয়া, বলা ভাল দারুণ সব শিল্পকর্ম দেখানোর সুযোগ পান পটশিল্পীরা। পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগেও শিল্পীদের দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রদর্শনীতে নিয়ে যাওয়া শুরু হয়। তারপরই অবস্থাটা ধীরে ধীরে পাল্টাতে থাকে। নয়া গ্রামের ৬৬টি পরিবারের কাছে পটশিল্প এখন আর বোঝা নয়, সম্পদ। আর বাইরে গান গেয়ে করুণার পাত্র হয়ে তাদের থাকতে হয় না। মেলা, প্রদর্শনীর সুবাদে তাদের ছবি ভাল বিক্রি হচ্ছে। অজ গাঁয়ের শিল্পীরাও হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়ার সাহায্যে তাদের কাজ অন্যদের কাছে ছড়িয়ে দিতে কিছুটা সক্ষম হয়েছেন।
দিনবদলের কাহিনি তাদের সৃষ্টিতেও প্রভাব ফেলেছে। চাঁদ সদাগর, চণ্ডীমঙ্গল, রাজা হরিশচন্দ্র, সাবিত্রী সত্যবান, রামায়ণ কিংবা মহাভারতের ছবি এঁকে থামছেন না পিংলার পটশিল্পীরা। তাঁরা এখন সুনামি, ২৬/১১-র মতো সমকালীন ঘটনাকেও পটের মধ্যে তুলে ধরেছেন। এমনকী পণপ্রথা, নারী নির্যাতন, এইডস, পালস পোলিওর মতো সামাজিক বিষয়গুলিও তাঁদের শিল্পকর্মের মধ্যে থাকছে। স্থানীয় শিল্পী সেরামুদ্দিন চিত্রকরের কথায়, মেলা-প্রদর্শনীতে যাওয়ার ফলে তাঁদের চোখ খুলে গিয়েছে। পটের প্রতি এমন চাহিদা যে থাকতে পারে তা আগে বুঝতে পারেননি। এই শিল্পীর মাসে গড়ে ৪০ হাজার টাকার বিক্রি হয়।
পটের কাজ মোটামুটি একশো টাকা থেকে শুরু। তিরিশ লাখ টাকা পর্যন্তও এর দাম আছে। পিংলার শিল্পীদের পটচিত্রের ব্যবসা বছরে প্রায় পাঁচ থেকে সাত কোটি টাকার ব্যবসা হয়। কোনও শিল্পী আবার বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে গাঁটছাড়া বেধে ওয়েবসাইটে নিজেদের হাতের কাজ তুলে ধরেছেন। এর ফলে বিদেশ থেকেও ভাল অর্ডার আসছে। পটের এমনই আবেদন যে, মেদিনীপুরের গ্রামে ভিক্ষা ভুলে সারা বছরই এমন প্রদর্শনী, মেলার জন্য হিল্লি-দিল্লি করতে হয় শিল্পীদের। মুম্বই থেকে বেঙ্গালুরু বা চেন্নাই, এলাহাবাদ। সর্বত্রই এখন পটচিত্রের কদর। নয়াগ্রামের কেউ পট নিয়ে গিয়েছেন অ্যাডিলেড, কেউবা বাংলার হস্তশিল্প তুলে ধরেছেন লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, প্যারিস কিংবা বার্লিন।
নয়াগ্রামের পটশিল্পীদের কাজের আরও একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাঁদের রং একেবারে পরিবেশ বান্ধব। বলা যেতে পারে মাটির গন্ধ থাকে রং-এ। সবটাই মেড ইন পিংলা। হাতের কাছে সিম দিয়ে শিল্পীরা তৈরি করেন সবুজ রং। ভুষা কালি দিয়ে কালো। অপরাজিত ফুল দিয়ে নীল। সেগুন গাছের পাতায় হয় মেরুন রং। আর লাল রং হয় পান-সুপারি-চুন দিয়ে। আবার পুঁই মিটুরি দিয়ে গোলাপি রং তৈরি হয়। হলদের ক্ষেত্রে রয়েছে কাঁচা হলুদ। পুকুর খোঁড়ার সময় যে মাটি পাওয়া যায় তা দিয়েই হয় সাদা রং। স্থানীয় কথায় যাকে ঘসু মাটি বলা হয়।
সংগঠিত হওয়ায় এখন শিল্পীর কম সুদে ঋণ পান। ব্যবসা বাড়াতে অনেকেই ঋণ নিয়ে ভাল কাজ করছেন। যার ফলে নয়া গ্রামের প্রায় ৫০০ মানুষ আজ শুধু স্বনির্ভর নয়, আশেপাশের মানুষদের কাছে ঈর্ষার কারণ। পটের হাত ধরে তাদের জীবন আচমকাই নতুন ধারায় বইতে শুরু করেছে। সেই স্রোত আরও বড় আকার নিয়ে দেশ, বিদেশের বাজারে আছড়ে পড়তে চান সেরামুদ্দিন, রাজেশরা।