কলকাতা দাপিয়ে বেড়াবে গুলাবি গ্যাং। আত্মমর্যাদার যাত্রাপথে ওরা দৌড়বেন। নিজের পায়ে দাঁড়াবেন। আর টেনে তুলে আনবেন সংসারকে। নিজের সংসার, বাবা মা, স্বামী পুত্র কন্যার চৌহদ্দিতে আর আশ্রিতা নন। তিনিই রোজগেরে গিন্নি।
বৃদ্ধ দরিদ্র বাবা মার সংসারে মৌসুমি, তন্দ্রা মমতাজরা আর গলগ্রহ নন। তারাই ভরসা। দিন আনি দিন খাই পরিবারে মেয়ে হয়ে জন্মানো আর অপমানের নয়, বরং সম্পদে বিপদে মেয়েরাও সমান শক্তি। আর কন্যা সন্তান হিসেবে ওদের হেয় করবে না কেউ। রীতিমত শক্ত জমিতে দাঁড়িয়ে লড়বেন পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। যুঝে নেবেন নিজেদের অধিকার। গোলাবি গ্যাং। না এটা ওদের কোনও গ্যাংয়ের নাম নয়। সিনেমার নামও নয়। এটা ওদের নতুন পরিচয়। কলকাতার রাস্তায় মহিলা অটো চালকদের পরিচয়। হ্যাঁ কলকাতায় ছুটবে দিল্লি কিংবা অন্য শহরের মতোই মহিলা চালিত অটো। এই প্রথম শুরু হতে চলেছে কলকাতায়। এই শহরের রাস্তায় গোলাপি রঙের অটো নিয়ে ছুটবেন প্রমীলা চালক বাহিনী। যদিও রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় মহিলা জেলাশাসকরা দুর্দান্ত কাজ করছেন। রাজ্যে চিকিৎসা ক্ষেত্রে মহিলা চিকিৎসক এবং সেবিকাদের সংখ্যাই বেশি। তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রেও মহিলা কর্মীর সংখ্যা পুরুষের সমান সমান। যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং নারী সেখানে নারী বিকাশের পথ যে প্রশস্ত হবে এ তো বাঞ্ছনীয়। তবুও এখনও বাংলার সমাজ ব্যবস্থায় মহিলাদের সামাজিক সুরক্ষা নেই। ঘরে ঘরে গৃহস্থ হিংসার শিকার হন মেয়েরা। আপামর মধ্যবিত্ত নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে মেয়েদের যে সম্মান তা হয় মা, নয় স্ত্রী কিংবা মেয়ে হিসেবে। সংসারের মাথা হিসেবে এখনও মেয়েদের মেনে নিতে পারে না বাঙালি সমাজ। এবার দক্ষিণ কলকাতা অটো-চালকদের ইউনিয়ন সেটাই করে দেখাল। এলাকার মেয়েদের অটো চালানোর প্রশিক্ষণ দিয়েছেন ওরা। শিখিয়েছেন ট্রাফিক আইন এবং রাস্তার সংস্কৃতিও। মহিলা অটো-চালকদের নিয়ে ভীষণই আশাবাদী ওরা। ফেব্রুয়ারিতেই চালু হয়ে গেল গোলাপি অটোর পরিষেবা। মহিলা চালিত পিঙ্ক অটো দিল্লির মতো এবার কলকাতাতেও। খুব শিগগিরই কলকাতার সব অটোরুটে দেখা যাবে মহিলা অটো-চালকদের। প্রাথমিকভাবে মাত্র তিন জন মহিলা চালক এবং ৩টি অটো দিয়ে টালিগঞ্জ—হাজরা রুটে শুরু হল যাত্রা। দক্ষিণ কলকাতার অটো ইউনিয়নের এক নেতা জানালেন, আপাতত জনা ষাটেক মহিলা চালককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেকেই পুরুষ শাসিত এই পেশায় আসার সাহস দেখিয়েছেন।
আজকাল মহিলারা নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাইছেন। একই সঙ্গে সংসার খরচের টাকাও দিচ্ছেন। অটো চালানোর এই পেশায় মহিলাদের আসাকে পূর্ণ সমর্থন করেছেন পুরুষ অটো-চালকরাও। ৬০ জনকে ওরা প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, বললেন দক্ষিণ কলকাতা অটো ইউনিয়নের নেতা গোপাল সুতার। তিনি জানান, মহিলা যাত্রীদের জন্য এই পিঙ্ক অটো ব্যবহার করা হবে। ওদের পরিকল্পনা আছে অটোগুলিকে গোলাপি রঙ করে দেওয়া হবে। যাতে দূর থেকে সেই অটোগুলি চিনে নিতে পারেন যাত্রীরা। পিঙ্ক অটো মূলত মহিলা যাত্রীদের জন্যেই ব্যবহার করা হবে, বললেন গোপাল-বাবু। আপাতত তিন অটো চালক মৌসুমি, তন্দ্রা এবং মমতাজ বেগম হাজরা থেকে টালিগঞ্জ এই অটোরুটে ছুটবেন। তন্দ্রার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। বলছিলেন, প্রথম প্রথম লজ্জা তো ছিল। কিন্তু লজ্জা করার কিছু নেই অটো চালক ভাইয়েরাই শিখিয়েছেন। ঘরের আর্থিক টানাটানির মধ্যে লোকের কাছে হাত পাতার ভিতর লজ্জা থাকতে পারে। অবৈধ কোনও কাজ করার মধ্যে লজ্জা থাকাটা জরুরি। কিন্তু ভালো কাজে গর্বিত হতে হয়। এভাবেই বুঝিয়েছেন দক্ষিণ কলকাতা অটো ইউনিয়নের নেতারা। তাই তন্দ্রা বলছেন অটোর স্টিয়ারিং ধরে উনি গর্বিত। বাড়িতে বুড়ো বাবা মায়ের মুখে দুবেলা সম্মানের আহার তুলে দিতে আনন্দই হবে। তন্দ্রা জানেন, মেয়ে হয়ে জন্মেছেন বলে গোটা পরিবারের কাছ থেকে কী নিদারুণ অভ্যর্থনা পেতে হয় মেয়েদের। ওর এই সাহসী পদক্ষেপ ওই সব ঠুনকো পুরুষতান্ত্রিক সামাজিকতাকে বিদ্রূপ করবে। এটা ভেবেই খুশিতে ডগমগ গুলাবি গ্যাংয়ের এই সদস্যা। তন্দ্রার সঙ্গে গলা মেলালেন মৌসুমি। মৌসুমি বলছেন, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ইচ্ছে তো ছিলই। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর অপশন খুব কম। লোকজন আগ বাড়িয়ে এসে খালি বলতেন এটা করতে পারো ওটা করতে পারো। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হত না। কিন্তু পরিবারের দিকে তাকালে চোখ ফেটে জল আসত। বাবা মা বুড়ো হয়েছেন। কী ভাবে তাদের ওষুধের টাকা জোগাড় করা যায় তাই নিয়েও হাজার ভাবনা চিন্তা করতে হত। এবার তাই সব দুর্ভাবনা সরিয়ে নিজেই নেমে পড়েছেন বাস্তবের মাটিতে। সামিল হয়েছেন গুলাবি গ্যাংয়ে। মমতাজের বক্তব্য স্পষ্ট। মেয়েদের জন্যেই মেয়েদের উচিত অটো চালানো। তার যুক্তি ক্ষুরধার। বলছেন মেয়েদের রাস্তা ঘাটে চলা ফেরা করতে হয় অনেক সমস্যার সম্মুখীনও হতে হয়। ওদের মতো মহিলা অটো চালকরা মেয়েদের ভরসা যোগাতে পারবে। পুরুষ অটো-চালকদের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানি সহ নানা অপরাধের খবর প্রায়শই সামনে আসে। অটো-চালক পুরুষ বলে মহিলাদের একাংশ অটোতে উঠতেই চান না। সেইসব মহিলাদের এবার অটো যাত্রা আরও নিরাপদ আর সুরক্ষিত হবে। রাত বিড়েতেও অটো চড়তে অসুবিধা হবে না। দুবার ভাবতে হবে না। তাই বোরখার আড়ালে পড়ে না থেকে অটো চালানোই স্থির করেছেন দরিদ্র সংখ্যালঘু পরিবারের মেয়ে মমতাজ। এবং তিনি নিজের পেশা নিয়ে দারুণ গর্বিতও। এক অটো ইউনিয়নের নেতা বলছিলেন, অটো চালাতে চেয়ে আরও মহিলা চালকদের আবেদন রাজ্য পরিবহণ দফতরের কাছে পাঠানো হয়েছে। আশা করা হচ্ছে দ্রুত সাড়া পাওয়া যাবে। কয়েক মাসের মধ্যেই হয়ত হাতে অনুমতি পত্র চলে আসবে। তখন রাস্তায় দল বেঁধে বেরবে পিঙ্ক অটো। মাতৃভূমি লোকাল চলতে পারলে রাস্তায় গোলাপি অটোও দারুণ চলবে বলছিলেন অটো-চালকদের একাংশ।
Related Stories
February 08, 2018
February 08, 2018
Stories by Hindol Goswami
February 08, 2018
February 08, 2018
February 08, 2018
February 08, 2018