ছিপখান... তাঁর প্রেম আর প্রেরণা

ছিপখান... তাঁর প্রেম আর প্রেরণা

Wednesday March 02, 2016,

4 min Read

image


শারদীয়া সান্যাল। তাঁর বড় হওয়া কলকাতার দক্ষিণে, বেহালা ছাড়িয়ে ঠাকুরপুকুর নামের একটি জায়গায়। স্কুলজীবন থেকেই তাঁর প্রেম কবিতা, আবৃত্তির প্রতি। প্রখ্যাত আবৃত্তিকার প্রদীপ ঘোষের কাছে আবৃত্তি পাঠের শিক্ষা নেওয়া তারই প্রতিফলন। তারপর কলেজ জীবনে আবৃত্তি পাঠ করে ঘরের আলমারিতে অসংখ্য ট্রফির উজ্জ্বল প্রদর্শনীও শারদীয়ার সাহিত্যমনস্ক মনেরই প্রতিচ্ছবি। কিন্তু কেউ জানতে পারে নি কবিতা প্রেমের ভেতরে লুকিয়ে ছিল প্রচণ্ড কর্মোদ্যোগী একটা মন! যেটা জানা গেল অনেক পরে। শারদীয়ার বিয়ের চার বছর পর, ১৯৯৯ সালে তাঁর স্বামীর এক বন্ধু একদিন গল্পচ্ছলে শারদীয়ার বাড়িতে বসে শুনিয়েছিলেন গল্পটা। শারদীয়া বললেন, “ছোট থেকেই আমাদের পাড়া, অন্যান্য জায়গায় বহু মানুষকে দেখেছি মাছ ধরতে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছিপ নিয়ে পুকুরের ধারে বসতে দেখেছি। এমনকি, বাবা, কাকা-দের মুখে শুনেছি মাছ ধরা নিয়ে অনেকে রীতিমতো গবেষণা করেন। কিন্তু মাছ ধরার ছিপের যে একটা বিরাট অর্থকরী বাজার আছে সেটা জানতাম না। আমার স্বামী, পার্থর সেই বন্ধু আমার সামনে একটা জানলা খুলে দিলেন। আমেরিকা ও ইউরোপ জুড়ে মাছ ধরার ছিপ যে কত বড় একটা পণ্য সেটা জানলাম। আর সেই গল্প শোনার পর থেকেই মনে হয়েছিল, চেষ্টা করে দেখা যাক না।”

শারদীয়ার প্রচেষ্টায় সবচেয়ে বড় সহায়ক ছিল স্বামীর অপরিসীম উৎসাহ। যে কারণে হার্ডলসগুলো পেরোতে শারদীয়ার অসুবিধা হয় নি। কিন্তু বাঁধার প্রাচীর গুলো খুবই উঁচু ছিল। স্বামীর কাছ থেকেই শারদীয়া জেনেছিলেন, হাওড়ায় ডোমজুড় ছাড়িয়ে মানসিংহপুর নামের একটি জায়গায় তৈরি হয় মাছ ধরার ছিপ। হাওড়ার আমতাও এই জিনিসের ঘাঁটি। শারদীয়া শুরু করলেন সেখানে যাওয়া। প্রায় প্রত্যেক দিন! সংসার সামলে। লক্ষ্য ছিল অভিনব এই ব্যবসায় নিজের নাম প্রতিষ্ঠিত করা। ভরসা ছিল স্বামীর অপরিসীম উৎসাহ, অদম্য এক মানসিকতা আর ঈশ্বর! কিন্তু বিনিয়োগের জন্য যে টাকারও প্রয়োজন ছিল। শারদীয়া বলছেন, “আমরা দু’জনে মিলেই জোগাড় করেছি। বাবার দেওয়া সোনার হারও বিক্রি করতে হয়েছে। অনেক পরে, সফল হওয়ার পর বাবা জেনেছিল ওই হার বিক্রির কথা। কিন্তু হাল ছাড়ি নি”। ১৯৯৯ থেকে ২০০০ সাল প্রায় দেড় বছর ধরে শারদীয়া হাতে কলমে কাজটা শিখেছিলেন। তাঁর বাড়ি থেকে দূরত্ব ছিল ৩৮ কিলোমিটার! প্রায় প্রত্যেকদিন সেখানে গিয়ে নিজের হাতে ছিপ তৈরির কাজ শিখে শারদীয়ার প্রথম ছিপ তৈরি করা ২০০১-এর মে মাসে। ফ্লাইফিশিং যন্ত্র। যে ছিপ দিয়ে বিদেশে মানুষ বিলাসিতা করে সময় কাটানোর জন্য মাছ ধরতে বসে। শারদীয়ার মানসিংহপুরের কারখানা থেকে সেই ছিপ ফ্লোরিডায় উড়ে গেল। অর্থকরী প্রাপ্তি? মাত্র ২১ হাজার টাকা। কিন্তু মানসিক প্রাপ্তি? আমরাও পারি! নতুন এই যাত্রায় জয় করার যে লক্ষ্য নিয়ে শারদীয়া হাঁটতে শুরু করেছিলেন ১৯৯৯-এ, তার তিন বছর পর ফ্লোরিডায় প্রথম ছিপ পাঠিয়ে শারদীয়ার মনে হয়েছিল, “রাস্তাটা ধরে হাঁটা যায়। এগোনোর রাস্তা আছে ভবিষ্যতে”।

কিন্তু ফ্লাইফিশিং যন্ত্র তখন কলকাতায় আরও জনা পাঁচেক লোক তৈরি করতেন। এটাও শারদীয়ার সামনে আর একটা লড়াই। বাকিরাও ফ্লাইফিশিং যন্ত্র তৈরি করছে। আমার ব্যবসা তাহলে কোথায় আলাদা? শারদীয়া বললেন, “স্বামীর পরামর্শে আমি ব্যবসাটাকে অনলাইন করে দিলাম। কলকাতায় তো বটেই, ভারতেও হয়তো সেটাই প্রথম অনলাইন ফিশিং কিট তৈরির ব্যবসা”।

সতেরো বছরের দীর্ঘ যাত্রাপথে শারদীয়া অনেক রকমের মাছ ধরার ছিপ তৈরি করেছেন। আমেরিকা ছাড়িয়ে তাঁর ব্যবসা বিস্তৃত হয়েছে ইউরোপের অন্যান্য দেশেও। ২০০১-এ একুশ হাজার টাকার প্রথম পাওয়া অর্ডার পরবর্তী সাত বছরের মধ্যে পৌঁছে গিয়েছিল প্রায় পঁচাত্তর লক্ষ টাকার এককালীন অর্ডারে! ফ্রান্স, কানাডাতেও তখন শারদীয়া চুটিয়ে ব্যবসা করছেন। কিন্তু অভিনব ব্যবসায় সাফল্যই কি তাঁর প্রাপ্তি? শারদীয়া বলছেন, “ঝড়, জল উপেক্ষা করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ব্যবসাকে দাঁড় করানোর মধ্যে কতটা আনন্দ সেটা বলার প্রয়োজন নেই। কিন্তু তার বাইরেও একটা প্রাপ্তি আছে। ২০০৪-এ বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দায় যখন চারিদিকে সমস্ত ব্যবসার ওলোট পালোট হওয়ার উপক্রম, সেই সময়েই আমার কাছ থেকে জিনিস নিয়ে আমেরিকার এক ব্যবসায়ী ওই দুর্যোগের মধ্যেও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ছিলেন!”

২০০৩-এ শারদীয়ার হাতে ঘটে যায় আরও এক বিস্ফোরণ! মানসিংহপুরে তাঁর কারখানায় তিনি তৈরি করে ফেলেন আন্ডার ওয়াটার ক্যামেরা হাউজিং। সমুদ্রের তলায় ৭০ ফিট পর্যন্ত নীচেও ক্যামেরা নিয়ে যাওয়া যাবে। ঝকঝকে ছবি তোলা যাবে! সমুদ্রের নীচে ক্যামেরাকে সুরক্ষিত রাখার একটি আবরণ! এই আবরণ তৈরি করার পর শারদীয়ার কারখানার লোকজনেরা তাঁর স্বামীর সঙ্গে চলে বাংলাদেশে। সমুদ্রের নীচে নেমে দামী ক্যামেরার গায়ে পরিয়ে সেটা পরীক্ষা করার জন্য। এই আবরণের দাম কমপক্ষে পঞ্চাশ হাজার টাকা! কিন্তু শারদীয়ার দুর্ভাগ্য; বিদেশেরই এক ব্যবসায়ী তাঁর সঙ্গে প্রতারণা করে আবরণ তৈরির স্বত্ব পর্যন্ত নিজের নামে করিয়ে নিয়েছেন।

সতেরো বছর ধরে অভিনব ব্যবসায় সাফল্য নিয়েই হাঁটার পর শারদীয়ার মনে হচ্ছে সরণিটা পরিবর্তন করলে কীরকম হয়। শারদীয়া বললেন, “ভাবছি পাটজাত দ্রব্যের উপর কাজ করব। নতুন কিছু করা যায় কিনা দেখছি”। শারদীয়া পারবেন। আবৃত্তি পাঠ করে অজস্র ট্রফি পাওয়ার সময় কেউ ভাবতে পারেনি মাছ ধরার ছিপ তৈরি করেও তাঁর ঝুলিতে আসবে একাধিক পদক! তাঁর অদম্য লড়াইকে এবার জানা হয়ে গিয়েছে। যে পারে, সে পারে।