ভারতকে তৃষ্ণার ‘ড্রপ’ দিচ্ছেন মার্কিন ড্রপ আউট

ভারতীয় পড়ুয়ারা জীবন ও জীবিকার উদ্দেশ্যে আমেরিকায় পাড়ি দেয়, এটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। মার্কিন মুলূকে গিয়ে তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রে কাজ করে অনেকে সেখানেই থেকে যান। এই রকম ভাবে ‘ব্রেন ড্রেন’ এখন খুবই পরিচিত একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।বেশিরভাগ উচ্চ মেধা সম্পন্ন ছাত্ররা আমেরিকায় যাওয়াটাকেই নিজেদের জীবনের সাফল্য বলে মনে করেন। প্রতি বছর, ভারতের ঘরে এইভাবে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার আসে।এ রকম একটা অবস্থায় ভারতের উন্নতির জন্য খোদ আমেরিকা থেকে ভারতে চলে আসা – সত্যিই ব্যতিক্রমী ঘটনা। অনেকটা বলিউডের “স্বদেশ” সিনেমার মতো মনে হয়। সেলুলয়েডে দেখা গিয়েছিল এক ভারতীয়েরই নিজের মাটিতে ফিরে উন্নয়নের কাহিনি। আর এখানে এখানে এক মার্কিনের ভারতের মাটিকে নিজের করে নেওয়ার গল্প।

ভারতকে তৃষ্ণার ‘ড্রপ’ দিচ্ছেন মার্কিন ড্রপ আউট

Thursday September 24, 2015,

4 min Read

সদ্য স্নাতকেরা এ দেশ থেকে আমেরিকায় যায় উচ্চশিক্ষা লাভের জন্যে। ২০১১ সালে, উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে আমেরিকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে ভারতীয় ছাত্রের সংখ্যা ছিল দ্বিতীয় বৃহত্তম। তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সিলিকন ভ্যালি, নিউ ইয়র্কের মতো জায়গায় নানা কাজের সুযোগও পেয়ে যান। কিন্তু এই গল্পটা একেবারে চেনা ছকের বাইরে। একটা সাধারণ ছেলে, যে কিনা ক্যালিফোর্নিয়ার একটি কলেজ থেকে ড্রপ আউট। ভারতে সিলিকন ভ্যালি তৈরির কাজ দিয়ে তিনি যাত্রা শুরু করেন। নাম তাঁর ডেভিড মিলার। মিলারের কথায়, “এটা একটা চ্যালেঞ্জিং কাজ ছিল। কিন্তু আমি এখন দেখতে পাচ্ছি আমার এই চ্যালেঞ্জ-এর প্রভাব এবং কীভাবে এটি মানুষকে উপকার করছে।” ডেভিন মিলার, ‘নেক্সট ড্রপ’-এর একজন সফ্টওয়্যার ডেভেলপার। তাঁর এই কোম্পানি শুরু হয়েছিল ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির বার্কলে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ক্লাসের প্রতিযোগিতায় একটি পাইলট প্রজেক্ট হিসাবে। গত বছর, এই ২০ বছরের মার্কিন তরুণ, অনু শ্রীধরণের কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ভারতে আসতে রাজি হন এবং ভারতের জল সমস্যা সংক্রান্ত কাজে সাহায্যের জন্যে এগিয়ে আসেন। অনু শ্রীধরণ হলেন ‘নেক্সট ড্রপ’ কোম্পানির সিইও এবং সহ-প্রতিষ্ঠাতা।


ডেভিড মিলার (ডানদিক থেকে দ্বিতীয়) সঙ্গে অনু শ্রীধরন এবং ‘নেক্সটড্রপ’ টিম

ডেভিড মিলার (ডানদিক থেকে দ্বিতীয়) সঙ্গে অনু শ্রীধরন এবং ‘নেক্সটড্রপ’ টিম


‘নেক্সট ড্রপ’-এর মূল প্রোডাক্ট হল সফটওয়্যার। এর ‘স্মার্ট গ্রিড লাইট’ সলিউশনের দ্বারা এই সংস্থাটি জল সরবরাহের তথ্য সংগ্রহ করে এবং শহরের বাসিন্দা ও অন্যান্যদের কাছে তা পৌঁছে দেয়। প্রত্যেকদিন বিশেষ কিছু কর্মী জলাধারের জলের পরিমাপ করেন। ‘নেক্সট ড্রপ’ সেই তথ্য পাঠিয়ে দেয় ইঞ্জিনিয়ারদের কাছে। তাঁরা ঠিক করেন চাহিদা অনুযায়ী কোন সময়ে কোন এলাকায় ঠিক কতটা জল পাবে। ইউটিলিটি বিভাগের কর্মীরা যখন এলাকার কোন‌ও জলাধার খোলেন তখন নেক্সটড্রপ-এর ইন্টার অ্যাক্টিভ ভয়েস রেসপন্স সিস্টেমে ফোন করেন এবং সেই সময় স্বয়ংক্রিয়ভাবে এলাকার বাসিন্দাদের কাছে এসএমএসের মাধ্যমে আপডেট চলে যায়। জল সরবরাহের ৩০ থেকে ৬০ মিনিটের আগে এই বার্তা পৌঁছে যায়। ভালভ কর্মী ঠিকঠাক তথ্য দিচ্ছে কিনা সেটা যাচাই করতে বাসিন্দাদের সঙ্গেও সংস্থার তরফে নিয়মিত যোগাযোগ করা হয়।

“আমরা একটি সামাজিক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা। আমরা চেষ্টা করছি আমাদের প্রোডাক্টকে উন্নত করে দুনিয়াকে পরিবর্তন করার এবং এভাবে সাধারন মানুষ ও সরকারের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতে চাই। এর জন্য মোবাইলের ভিত্তিতে একটি শ্রেণি গড়ে তোলা হচ্ছে, যারা মোবাইলের সাহায্যে নিজেদের মত প্রকাশ করতে পারবে। যে মতামত সরকারের কানে যাওয়া খুব জরুরি। প্রতিদিন মানুষের কাছ থেকে পাইপের ত্রুটি বা কম জলের চাপ ইত্যাদি সমস্যা সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করে আমরা তা ইউটিলিটি বিভাগে পাঠিয়ে দিই। এর ফলে তারা ঠিকমত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।” বললেন ডেভিন।


image


২০১১ সালে ‘নেক্সট ড্রপ’ শুরু হয়। প্রথম এটি হুবলি-ধারওয়ারে কাজ শুরু করে। হুবলি যারা কর্নাটকের যমজ শহর নামে পরিচিত। ডেভিন জানালেন কেমন করে তাঁরা সবকিছু ঘুরে দেখতেন, বিভিন্ন এলাকা বাছাই করতেন এবং দেখতেন মানুষ কীভাবে কোনওরকম জলের সরবরাহ ছাড়াই বেঁচে থাকে কিংবা জল আনার জন্যে বালতি হাতে নিয়ে কত দূর তাঁদের হাঁটতে হয়। “আপনাকে সত্যিই এটা ভাবাবে, আপনি অনুভব করতে পারবেন যে জীবন তাদের কাছে কত কঠিন। আমি চেষ্টা করি এগুলোকে সবসময় মনে রাখার। এসব আমি আমার জার্নালে লিখে রাখি, যাতে বৃদ্ধ বয়সেও আমি এগুলো আবার মনে করতে পারি”, বললেন ডেভিন।

হুবলিতে নেক্সটড্রপ প্রায় ১৬ হাজার পরিবারে মেসেজ পাঠায়। প্রতি সপ্তাহে তারা এই ব্যাপারে মতামত পায়। ‘নেক্সট ড্রপ’ সলিউশন আসার আগে এলাকার মানুষকে প্রতি মাসে প্রায় ২০ থেকে ৪০ ঘন্টা অপেক্ষা করে থাকতে হত জলের জন্য। কখনও কখনও তাঁদেরকে জল আনার জন্য কাজ থেকে ছুটি নিতে হত।

বর্তমানে, ‘নেক্সট ড্রপ’ বেঙ্গালুরুতেও ছড়িয়ে পড়েছে। প্রায় ৫০০ পরিবারকে তারা পরিষেবা দেয়। পুরো শহরে খুব তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। “বেঙ্গালুরুর সমস্যাটি হল এর জনসংখ্যা। এখানে থাকেন প্রায় ১ কোটি ১০ লক্ষ মানুষ। কিন্তু জল সরবরাহের ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে মাত্র ২০ লক্ষের জন্যে। সুতরাং, সবার জন্যে যথেষ্ট জল নেই”, ডেভিন জানালেন। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে যখন যেখানে সমস্যা খুঁজে পান তা নোট করে রাখেন এবং তারপর সেটাকে সিস্টেমে আপলোড করে দেন। এসএমএস পরিষেবার জন্য গ্রাহকদের থেকে প্রতি মাসে ১০ থেকে ২৫ টাকা নেওয়া হয়। যদিও সেটা নির্ভর করে কোন শহরে আপনি আছেন তার উপর। হুবলির ২৫ হাজারেরও বেশি গৃহস্থালি এই সুবিধার আবেদন জানিয়েছে। এই তথ্য জল বিভাগ ও অন্যান্য বিভাগের তথ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই করা হয়। ‘নেক্সট ড্রপ’ এখন জল সরবরাহের কাজ করছে, কিন্তু এদের পরিকল্পনা আছে আরও অন্যান্য কাজেও নিজেদের বিস্তার ঘটানো। যেমন, রাস্তা ম্যানেজমেন্ট, বর্জ্য পদার্থ ম্যানেজমেন্ট এবং সরকারের অন্যান্য কাজের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করা। পরবর্তী ২ বছরের মধ্যে, তারা ভারতের অন্যান্য শহরেও নিজেদের ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে।

“যত আমরা নিজেদের কাজের ক্ষেত্র বাড়বে, তত আমাদের এসএমএস সার্ভিসের মাধ্যমে আরও অনেক মেসেজ পাঠানোর ও আরও বেশি ফোন রিসিভ করার ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে।এই পরিকাঠামো গড়ে তুলতে ‘নেক্সট ড্রপ’ বেশ কিছু ভয়েস কল সংস্থার সঙ্গে পার্টনারশিপ গড়ে তুলেছে। আমরা চাই মানুষের প্রয়োজনের কথাটা তুলে ধরার। জানি সব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়, কিন্তু চেষ্টা তো করা যায়। তাই, আমরা ভারতের জলসমস্যা সমাধান করতে অন্তত কিছু সাহায্য করতে পারি। ভারতে আসার পর, আমি দ্রুত উন্নয়ন দেখেছি। দেখেছি মানুষকে প্রথমবারের জন্য প্রযুক্তি ব্যবহার করতে। উন্নতি হচ্ছে এবং সেই উন্নতির উপর আমরা বিশেষ প্রভাব ফেলতে পারি। জনগনকে মোবাইল সিটিজেন হয়ে উঠতে সাহায্য করতে পারি। এই পরিবর্তনের সাক্ষী হওয়া সত্যিই একটা দারুন ব্যপার”, ডেভিডের গলায় আত্মবিশ্বাস যেন ঝরে পড়ে। দূরদৃষ্টি এবং কঠোর পরিশ্রমের জন্য ডেভিড মিলারই যেন বাস্তবের ‘স্বদেশ’-এর নায়ক।