প্রতিভার বাজার আছে, জেনে নিন WhatsurSkill

প্রতিভার বাজার আছে, জেনে নিন WhatsurSkill

Wednesday June 29, 2016,

5 min Read

রোববারের সকালটা কি আপনার রেওয়াজি খাসি কেনার লাইনেই কাবার হয়ে যায়? আপনি যখন ঢাউস ঝোলা নিয়ে বাজার করতে ছোটেন তার অনেক আগে কাক ভোরে একদল ছেলেমেয়ে প্রতি রবিবার এদিক ওদিক ছোটে কাঁধে ক্যামেরা নিয়ে, লেন্স গুছিয়ে। সকালটা অন্যরকম শুরু হয়। এরকম লেন্স রাইডারদের নিয়েই আজকে আপনাদের বলব একটা গল্প। 

image


এইতো ২৬ জুন। রবিবার সকালে সিং ভেঙে বাছুরের দলে আমিও ভিড়েছিলাম। তার আগের দিন WhatsurSkill এর মোহিত জৈন আমাকে ফোন করে। সব সময় ছটফট করছে ছেলেটা। কলেজ ড্রপ করে চেন্নাই থেকে কলকাতা এসেছে WhatsurSkill -এ কাজ করবে বলে। ও ফোনে বলেছিল আসতেই হবে। হাওড়া ব্রিজের কাছে মল্লিক ঘাট ফুলের বাজারের ভিতর যে পালোয়ানদের ঘাট আছে সেখানে ওরা পৌঁছে যাবে সকাল ৬ টায়। ইভেন্ট শুরু হবে সাড়ে ছটায়। 

এই Photowalk এর আয়োজন করেছিল DSLR- Digital Showcase of Lense Riders নামে একটি সংস্থা। এটা ওদের চতুর্থ ইভেন্ট। এবং কলকাতায় ওই সংস্থার প্রথম ইভেন্ট। আর মোহিত-অঙ্কিতদের WhatsurSkill এর স্পন্সর।

আমি প্ৰথমে নিমরাজি ছিলাম। কিন্তু WhatsurSkill নামটায় এমন চ্যালেঞ্জ আছে যে সেটা অ্যাকসেপ্ট না করাটাই হেরে যাওয়া। তাই ভাবলাম নিয়েই নিই সকালে উঠে ফুল বাজারে পৌঁছনর পাঙ্গা। আমার এক সাংবাদিক বন্ধু সুজয় দাসকেও বললাম, 'যাবে নাকি!' নতুন ক্যামেরা কিনেছে সুজয়। ডিজিটাল এসএলআর। ওর এটা অনেক দিনের শখ ছিল। ছবির শখ। মোবাইল কিনত ক্যামেরার মেগাপিক্সেল, লেন্সের কোয়ালিটি দেখে। এখন নতুন শখের ক্যামেরা কিনে দারুণ সব ছবি তুলছে। ফেসবুকে, ইনস্টাগ্রামে, ট্যুইটারে তুলে দিচ্ছে। মেয়ের ছবি। ঘরের দেওয়ালে মেয়ের আঁকা নানান রঙের ঢেউ খেলানো কারুকার্য। আর তাইই শয় শয় লাইক পাচ্ছে।

একসময় আমারও শখ ছিল ফটোগ্রাফি। কিন্তু ইন্ডিয়া ডিজিটাল হলেও আমার আর ডিজিটাল হওয়া হয়নি। পুরনো দিনের অ্যানালগ এসএলআর। দুটো লেন্স। ৭০ থেকে ২১০ আর, সাধারণ ৫০ এম এম। বছর খানেক পর ওটার খোঁজ পড়ল। ২৬ তারিখ ফোটো ওয়াকের আয়োজন করেছে ওরা। ফলে ভাবলাম ফিল্ম কিনব। ক্যামেরাটায় হাত দিলেই হাত কেমন নিসপিস করে ওঠে। আমার দূরপাল্লার লেন্সটায় অসাধারণ ম্যাক্রো করা যেত। একটা ফিল্ম কিনতে ২৫ তারিখ আমার মতো কুড়ে মানুষ ঘণ্টা ছয়েক রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছে। মনে আছে আমি শেষ ফিল্ম কিনেছিলাম ১২০ টাকা দিয়ে। প্রো, চারশো স্পিডের। এখন ২০০ স্পিডের পুরনো স্টকের একটা ফিল্মের দাম পড়ে শ-দুয়েক টাকা। নতুন করে জানলাম। তাও ১৬ টা স্টুডিও ঘুরে একটা ফিল্মও পেলাম না। টের পেলাম আমি অ্যান্টিক হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু তাও আমাকে ফোটো-ওয়াকের আগেই ৬ ঘণ্টা হাঁটিয়ে নিল হাওড়ার এই স্টার্টআপ। ওখানে পৌঁছে আলাপ হল যাদের সঙ্গে তাদের গড় বয়স চব্বিশ। একজন তো এতোটাই উত্তেজিত ছিল ভোর সাড়ে চারটে থেকে অপেক্ষা করেছে সকালের প্রথম আলোয় হাওড়া ব্রিজের ছবি তুলবে বলে। ফুল বাজারের লোকজন ক্ষ্যাপাই ভাবছিল। কিন্তু ঘণ্টা খানেকের মধ্যে ক্যামেরা কাঁধে সগোত্রের লোক জন চলে আসায় এযাত্রায় সামলে নিয়েছে। শুধু সামলে নিয়েছে বললে ভুল হবে দল বেঁধে যখন লেন্স রাইডাররা এলেন তখন রীতিমত গোটা ঘাট, ফুলের বাজার দখল করে নেওয়ার হিম্মত রাখে ওই পুঁচকে ছোকড়া। একটু একটু করে পিঠের ব্যাকপ্যাক থেকে বেরল তার নিজস্ব প্রেমের কামান। দূর পাল্লার সব লেন্স। নদীর এপাড় থেকে হাওড়া স্টেশনের গম্বুজের মাথায় বসে থাকা ছোট্ট পাখিটাকেও সে ফুল ফ্রেমে দেখতে পায়। ততক্ষণে ওখানে জড়ো হয়ে গিয়েছেন শখানেক মুহূর্ত-সন্ধানী লেন্স রাইডার। দিল্লি থেকে এসেছেন মোহিত তেজপাল, বেনারস থেকে এসেছেন নিশান্ত পাণ্ডে, সৈয়দ ওয়াসি হায়দর। গোটা টিমকে নেতৃত্ব দিতে সেনাপতি হিসেবে হাজির আন্তর্জাতিক স্তরে পরিচিত ফটোগ্রাফার অভিষেক দাস। 

image


একদম এটাই করে WhatsurSkill, আপনার ভিতর লুকিয়ে থাকা অবদমিত শিল্প সত্তাকে খুঁচিয়ে দেয় আর একটা কমিউনিটি তৈরি করে আপনার নিঃসঙ্গতা ঘুচিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। এসবের মধ্যে দিয়েই উঁকি দেয় লুকোনো প্রতিভা। ওঁরা আপনাকে নিত্য নৈমিত্তিক প্রতিযোগিতার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। আরও ভালো আরও অসাধারণ কিছু করার অনুপ্রেরণা দেয়। আপনি যদি পারেন তাহলে আপনি জিততেও পারেন পুরস্কার। ২০১৪ এই কাজটা করার জন্যেই উঠে পড়ে লেগেছেন কলকাতার ছেলে রোহিত কেডিয়া। রোহিত পেশায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট। কেপিএমজিতে কাজ করেছেন। পুনেতে একটি সংস্থায় উঁচু পদে চাকরি করেছেন। সৃজনশীলতা এবং উদ্যোগের দুনিয়া সব সময়ই রোহিতকে টেনেছে।

২০১৪ সালে প্রথম যখন আইডিয়া খেলে রোহিতের মগজে তখন ও কলকাতার বাইরে। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির শহর কলকাতা ছেড়ে পুনেতে থাকার সময় এই শহরের প্রাণশক্তিকে টের পান রোহিত। বলছিলেন, “শুরুটা একটা অসম্ভব প্যাশনের মধ্যে দিয়ে হয়েছিল। ডোমেনের কী নাম হবে সেটা ঠিক করতেই রাত কাবার করে দিয়েছিলাম আমি আর আমার বন্ধু নিখিল। পাঁচশটা নামের মধ্যে থেকে নামটা বাছা হয়েছিল। What is your skill? বা WhatsurSkill? আমরা চারটি বিভাগে ভাগ করেই কাজটা শুরু করি। ফোটোগ্রাফি, আঁকা, গ্রাফিক্স আর কনটেন্ট। কলকাতায় ভাই অঙ্কিত কেডিয়াকে দায়িত্ব দেওয়া হয় বাণিজ্যিক স্ট্র্যাটেজি তৈরি করার। ইতিমধ্যেই ৩৫ হাজারেরও বেশি সৃজনশীল মানুষ আমাদের সংস্থায় রেজিস্টার করেছেন। ২৫টি ক্লায়েন্ট পেয়ে গিয়েছি আমরা”

image


রোহিত এবং অঙ্কিত দুজনেই বললেন, তাঁদের সংস্থার মত ভূভারতে আর কোনও সংস্থা নেই যারা শিল্প সাহিত্য এবং সংস্কৃতির জন্যে এভাবে বাণিজ্যিক মঞ্চ তৈরি করে দেন।

কলকাতা থেকে যাত্রা শুরু করলেও সংস্থার দুই প্রতিষ্ঠাতাই বললেন, সাফল্য কিন্তু প্রথমেই কলকাতায় আসেনি। ওরা যে তৎপরতার সঙ্গে সহযোগিতা পেয়েছেন অন্য রাজ্যে তার বিন্দুবিসর্গও কলকাতায় পাননি। যেমন উত্তরাখণ্ড পর্যটন দফতর ওদের প্রস্তাব পাওয়া মাত্রই লুফে নিয়েছে। উত্তরাখণ্ডের পাহাড়ে পাহাড়ে ছবি তোলার ওয়ার্কশপ করিয়েছেন ওঁরা। সরকারি ভাবে দারুণ সাড়াও পেয়েছেন। কেরলেও সাড়া পেয়েছেন দুর্দান্ত। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে বুঝিয়ে উঠতেই জুতোর সোল ক্ষয়ে গিয়েছে।তবুও কলকাতা কলকাতাই। এই শহরেই একটা ছোট্ট গ্যারাজ ঘরে শুরু হয়েছিল কর্মকাণ্ড। তিন জনের একটা ছোট্ট টিম। কিন্তু সেই টিমে কোনও টেকনিকাল এক্সপার্ট না থাকায় ওয়েবসাইট তৈরির কাজ একটি সংস্থাকে দেওয়া হয়। ২ মাসের বেশি সময় নষ্ট করে গোটা প্রজেক্টটাই ঝুলিয়ে দেয়। আরেকটি অসুবিধে হল কলকাতার শিল্পীদের মধ্যে এখনও ডিজিটাল সচেতন না হওয়ার মাশুল গুনতে বাধ্য হচ্ছেন দুই কেডিয়া ভাই।

গোটা দেশে তাই ছড়িয়ে পড়াই একমাত্র বাঁচার পথ ছিল। আর সেটা করতেই WhatsurSkill দাঁড়িয়ে গেল। ইভেন্ট যেমন চলছে তেমনি তার পাশাপাশি ছবি আঁকার চাহিদা মত তার যোগান দেওয়ার মধ্যে দিয়েও মা লক্ষ্মীর দর্শন হচ্ছে রোহিতের। পাশাপাশি বিজ্ঞাপন তো আছেই। এমনকি ওঁদের পোর্টালটি রীতিমত শিল্পের, ফোটোর বাজার খুলে দিয়েছে। এখন অপরিচিত অথচ অসাধারণ শিল্পীর আঁকাও উপযুক্ত মূল্য পাবে।

রোহিতের এই সোনায় বাঁধানো আইডিয়া তৈরি করেছে একটা দুর্দান্ত টিম। রোহিতের সাফ কথা আইডিয়া শেষ কথা নয় আসল ভেলকিটা দেখিয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বেঁছে নিয়ে আসা এই টিমটা। অঙ্কিত, ওম, অভিষেক, মোহিত, নিতিন, নয়না, রাকেশ, পায়েল আর কৌশিক। এই টিমের স্পিরিটটাই ওদের প্যাশনকে সাফল্যে রূপান্তরিত করেছে।