‘সানকল্প’এর সংকল্প, গ্রামের ঘরে ঘরে সৌরবিদ্যুৎ

‘সানকল্প’এর সংকল্প, গ্রামের ঘরে ঘরে সৌরবিদ্যুৎ

Friday August 28, 2015,

4 min Read

image


উত্তরপ্রদেশের এক ছোট্টগ্রাম গুলাবগঞ্জ। মঙ্গলযানের সাফল্য যদি আলো হয়, গুলাবগঞ্জ তাহলে ঘন অন্ধকার। নিচু ছাদ।মাটির কুড়ে ঘর। মলিন শাড়ি পরা এক বৃদ্ধা দাওয়ায় বসে।কপালে গাঢ় ভাঁজ। মাথা তুলে হতাশ চোখে তাকালেন। তারে ঝুলছে একটা তেল চিট চিটে বাল্ব। সারা জীবনে বড়জোড় একবার কি দুবার জ্বলতে দেখেছন ওই বাতি। ভাবছিলেন আর কি কখনও জ্বলবে? তবে ছেলে মেয়ে নাতি নাতনিরা আলো পাবে এমন একটা আশা মনের কোণে আছে বৈকি। 

সিনেমা নয়, অনুন্নত দেশের দুর্দশার ছবি আঁকা কোনও উপন্যাসের শুরুও নয়।এটাই সত্যি। আমাদেরই আশেপাশের ছবি। ভারতে এমন অনেক গুলাবগঞ্জ এখনও রয়েছে। বিদ্যুতহীন । এদের মধ্যে এমনও অনেক গ্রাম আছে যেগুলি বিদ্যুতায়ণ প্রকল্পের আওতায় রয়েছে বছরের পর বছর। কিন্তু তালিকায় থাকাই সার। এতদিনেও বিদ্যুতের পোস্ট বসেনি। আলো আসা তো দূরের কথা।

বিদ্যুতায়ণের সংজ্ঞাটাওবেশ মজার। ঘরে আলো জ্বলুক বা না জ্বলুক,মানুষ বিদ্যুতের পরিষেবা পান ছাই না পান, ১০শতাংশ বাড়িতে শুধু সংযোগ থাকলেই নাকি বলা হবে গ্রামে বিদ্যুতায়ণ হয়েছে। গুলাবগঞ্জও উত্তরপ্রদেশের তেমনই এক প্রত্যন্ত জনবহুল গ্রাম যেখানে তথাকথিত বিদ্যুতায়ণ হয়েছে। এবং যথারীতি গ্রামের কোথাও তার বিন্দুমাত্র পরিষেবা পৌঁছায়নি। একমাত্র পূর্ণিমার রাতে ঝলমল করে গুলাবগঞ্জ, চাঁদের আলোয়।

image


এখানেই শেষ নয়, আরও বিদ্রুপ অপেক্ষা করছে গ্রামটির জন্য। উত্তরপ্রদেশের এই গ্রামটি ‘অম্বেদকর গ্রাম’ হিসেবে ঘোষিত। সমস্ত সরকারি সুযোগ সুবিধে পাওয়ার আওতায় পড়ে। সরকার থেকে রাজনীতিবিদ,স্থানীয় নেতাদের কাছ থেকে উন্নয়নের ভুরি ভুরি মিথ্যে প্রতিশ্রুতি গ্রামবাসীদের মধ্যে অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি করেছে। পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে, এখন আর কোনও প্রতিশ্রুতিই ওদের কাছে খুশির হাওয়া নিয়ে আসে না।

কণিকা খান্না

কণিকা খান্না


এমনই যখন অবস্থা তখন দলবল নিয়ে গ্রামে হাজির হলেন কণিকা খান্না, ‘সানকল্প এনার্জি’র প্রতিষ্ঠাতা। কণিকা জানিয়ে দিলেন গ্রামে বিদ্যুতায়ণ করতে এসেছেন তাঁরা। খুশি তো দূর, গোটা গ্রাম উলটে সন্দেহের চোখে দেখছিল। কণিকাদের গোটাদলটি সৌরশক্তির সাহায্যে গুলাবগঞ্জকে বিদ্যুৎশক্তিতে স্বাবলম্বী করার প্রস্তাব দিতেই গোটা গ্রামের বাতাসে ভাসতে শুরু করল পরিহাস। ঠাট্টা। তির্যক মন্তব্য। এতটা উপহাস আর সন্দেহ ‘সানকল্প’ প্রকল্পের দলকে সহ্য করতে হয়েছিল যে তা ভাবতেই এখনও দমবন্ধ হয়ে আসে সংস্থার সদস্যদের। 

‘সানকল্প এনার্জি’ এমন একটি সংস্থা যারা সৌরশক্তি ব্যবহার করে নানা কাজ করে থাকে। যেখানে তাঁদের প্রয়োজন বোঝেন সেখানেই সঙ্গীসাথি নিয়ে পৌঁছে যান কণিকা। আরও একটা কাজ করেছেন, খুঁজে নিয়েছেন এমন বেশ কিছু গ্রামীণ এলাকা যেখানে বিদ্যুতায়ণ খুব বেশি প্রয়োজন। ভারতজুড়ে এক লাখেরও বেশি গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি এখনও। সেগুলির মধ্যে থেকে যেকোনও একটা বেছে নিতেই পারতেন। প্রতিকূলতা, হাজারো বাধা, অসহযোগিতা, অবিশ্বাস-এই সবকিছুর সঙ্গে লড়তে হবে জেনেও ‘সানকল্প’ কিন্তু কাঁটার পথেই পা বাড়িয়েছিল। বেছে নিল সেই গুলাবগঞ্জকেই। 

image


‘সোলার সোলজার’ বা ‘সৌর সৈনিক’ গড়ে শুরু হল গুলাবগঞ্জে ‘সানকল্প’এর মিশন, গ্রামে বিদ্যুৎ আসবেই, সংকল্প করে বসল ‘সানকল্প’। সোজা কথায় বলতে ‘সোলার সোলজার’ আদতে সৌরশক্তির মাধ্যমে গ্রামে গ্রামে শক্তি উৎপাদনের ব্যবস্থা করে।আর তার জন্য যা খরচাপাতি সেটা আসে গ্রামেরই মানুষের কাছ থেকে চাঁদা তুলে। ওই চাঁদার টাকায় প্রকল্পের প্রথমিক খরচটুকু উঠে গেলেই ব্যাস, আর ফিরে তাকাতে হয় না। বাকি রক্ষণাবেক্ষণের খরচ একেবারেই নামমাত্র। গ্রামের গ্রাহকরা বিদ্যুতের যে দাম দেন সেখান থেকেই উঠে আসে রক্ষণাবেক্ষণের খরচের টাকা। সৌরশক্তি থেকে যে বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা হয়,তার দেখভালের দায়িত্বও থাকে গ্রামবাসীদের ওপর। অর্থাৎ তাদের নিজেদেরই সম্পদ ওই সোলার এনার্জি প্ল্যান্ট। 


image


‘সানকল্প’এর পরিকল্পনা ছিল গ্রামে ২ কিলোওয়াটশক্তি সম্পন্ন একটি প্ল্যান্ট তৈরি করা, যাতে প্রতি বাড়িতে দুটো লাইট, একটা ফ্যান এবং একটা চার্জিং পয়েন্ট চালানোর ব্যবস্থা করা যায়। বিদ্যুৎ পৌঁছবে স্কুল,কলেজ, দোকানপাট, যে যেমন চাইবে। গ্রামেরই একজনের ওপর দায়িত্ব থাকবে মিটার দেখা, বিলের টাকা তোলা এবং প্ল্যান্টের দেখাশোনা করা। যতটা চ্যালেঞ্জের মুখে কণিকা পড়বেন ভেবেছিলেন তার চাইতেও বেশি কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল। মুষড়ে পড়েছিলেন। 

‘গ্রামবাসীরা আমাদের বিশ্বাস করছিলেন না।দফায় দফায় বৈঠক, আলোচনা, বোঝানো সব মিলিয়ে অনেকটা সময় লেগেছিল গ্রামের পঞ্চায়েতের কাছ থেক অনুমতি পেতে। শহরেই চাঁদা তুলে এইসব প্রকল্পের কথা ভাবা যায় না।সেখানে গুলাবগঞ্জ তো গণ্ডগ্রাম। কেন তাঁরা এই প্রকল্পের জন্য টাকা দেবেন সেটা বোঝানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল’, বলছিলেন কণিকা। 

পঞ্চায়েতের অনুমতি পেতেই প্রকল্পের জন্য ৯৩ শতাংশ গ্রামবাসীর সম্মতিও মিলে গেল। ব্যাস, ওটাই ছিল চ্যলেঞ্জ। গ্রামবাসীরা রাজি হতেই আরও কোনও বাধা রইল না। 

ছোট ছোট জায়গায় শক্তি প্রকল্প গড়তে ‘সৌর সৈনিক’রা কাজ করে চলেছেন। প্রাথমিকভাবে ‘সানকল্প’ যে ২৫০০ ডলার বিনিয়োগ করছিল সেটা অনেকটাই বেড়েছে। ৫ সদস্যের ‘সোলার সোলজার’ যেভাবে সাড়া পাচ্ছে তাতে উৎসাহের পারদ ক্রমশ চড়ছে।যদি আপনিও ‘সৌর সেনা’র অংশ হতে চান, এগিয়ে যান। যতটা পারবেন লড়ে নিন। কারও না কারও জীবনে ঠিক আলোর রেখা এঁকে দিতে পারবেন।