আমি আজ আপনাদের আনন্দা শঙ্কর জয়ন্তের গল্প বলব। খুব কম মেয়েই তাঁর মতো সাহসী হৃদয়ের অধিকারী। আনন্দা মূলত একজন নৃত্যশিল্পী। তাল তাঁর পায়ের ছন্দে মঞ্চে যাদু ছড়ায়। তাঁকে নাচতে দেখলে মনে হয়, "সে যেন মায়ামৃগী বিতরি কস্তুরি।" আভা অনির্বাণ শিখার মতো উজ্জ্বল। কোনও ঝড় কোনও দিন সেই শিখাকে নেভাতে পারেনি। জীবন আনন্দাকে দুহাত ভরে দিয়েছে। আবার নির্দয়ের মতো কেড়েও নিয়েছে। কিন্তু তিনি কখনও দুর্বলতার পরিচয় দেননি। সমস্ত লড়াই লড়েছেন সাহসিকতার সঙ্গে। যেভাবে মেঘের আড়ালে সূর্য হাসে ঠিক সেভাবে জীবনের সব কঠিন পরিস্থিতি বারবার পরাস্ত হয়েছে তাঁর দুর্দমনীয় সত্তার কাছে।
সৃজন ছন্দে আনন্দে...
ছোট্ট আনন্দার তখন চার বছর বয়স। নাচ শিখছেন। তিনি বলেন,ঈশ্বরের কাছে তাঁর প্রার্থনার একমাত্র মাধ্যম নাচ। মায়ের কাছে প্রথম নাচের তালিম। সেসব স্মৃতি আজও উজ্জ্বল। তিরিশ বছরের নৃত্যজীবনে কোনোদিন তাঁর পা থেমে থাকেনি। নাচ অনেক সম্মান দিয়েছে। তিনি নেচেওছেন প্রাণ ভরে। আনন্দার মননে, চেতনে, রক্তে সর্বত্র নাচ। চেন্নাইের বিখ্যাত কলাক্ষেত্র থেকে ছ'বছরের কোর্স করেছেন। এই ধরনের কঠিন কোর্স অনেকেই তিনচার বছর পরে ছেড়ে দেন। ভারতনাট্টম ছাড়াও শিখেছেন কর্ণাটকী মিউজিক,বীনা,দর্শন, কোরিওগ্রাফি, নাট্টুভাঙ্গম। মাত্র আঠারো বছরে ভারত সরকার তাঁকে ভারতনাট্টম শেখার স্কলারশিপ দেন। তিনি নৃত্যসম্রাট পশুমর্থি রামালিঙ্গ শাস্ত্রীর কাছে কুচিপুরী নৃত্য শেখেন।
নাচ আনন্দার নেশা। কলাক্ষেত্র থেকে বেড়িয়ে নাচ শেখাতে শুরু করেন। পাশাপাশি চাইতেন আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে। বাণিজ্যে স্নাতক। ইতিহাস,শিল্প ও সংস্কৃতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী পাওয়া আনন্দা দেখতেন বন্ধুরা UPSC-র চাকরী পেতে মরিয়া। তিনি যে শুধু চাকরীর পরীক্ষা দিলেন তাই নয়, UPSC-তে টপার হলেন। যোগ দিলেন দক্ষিণ ভারতীয় রেলওয়ের তৎকালীন প্রথম মহিলা অফিসার হিসেবে।
আনন্দা বলছিলেন, সবাই খুব খুশী। কিন্তু মা বেজায় চটে গেলেন। বলেছিলেন,"তোর নাচ করা হবেনা। এভাবে তোকে দেখব বলে আমি এত কষ্ট করিনি।" আনন্দা তাঁর মাকে আশ্বাস দেন যে নাচকে তিনি কখনো অবহেলা করবেন না।
মজার ব্যাপার হল তিনি ছিলেন বয়েজ ক্লাবের মহিলা অফিসার। সবাই তাঁকে স্যার বলে ডাকত। তিনিও একাধারে কন্ট্রোল রুমের দায়িত্ব থেকে শুরু করে ট্রেনিং, প্রশিক্ষণ বা দুর্ঘটনাগ্রস্থ এলাকার নিরীক্ষণ সব সামলাতেন একা হাতে। কেউ প্রযুক্তিগত সমস্যার অভিযোগ করতে ফোন করলে তাঁকে পুরুষ অফিসারের মেয়ে ভেবে ভুল করত। পুরুষশাষিত সমাজে আনন্দা একজন কর্মযোগী মানুষ হিসেবেই পরিচিত হতে চেয়েছেন। তিনি বলেন,"আমি কোন লিঙ্গের সেই পরিচয় বাড়িতে ফেলে কাজে যাই।"
একমাত্র নাচের সময় নারীস্বত্তাকে আহ্বান করেন আনন্দা। রাগ তালে ছন্দে ঠিকরে বেরয় তাঁর সমগ্র লাস্য। শ্রীকৃষ্ণম বন্দে জগৎগুরুম,বুদ্ধম স্মরণম গচ্ছামি, যোগরাজ রামায়ণম ও তলাপাত্র সবকটি নৃত্যনাট্যে আধ্যাত্মিকতা ও লোকনৃত্যের ছোঁয়ার এক অনির্বচনীয় মিশেল। শ্রীঙ্গারোদর্পণম ও রামোনামম-পুরাণাশ্রীত। আবার ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে লিঙ্গ বৈষম্য নিয়ে তাঁর নৃত্যনাট্য হোয়াট অ্যাবাউট মি চমকে দেয় তাঁর দর্শকদের। পুরস্কারও পেয়েছেন প্রচুর। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে সমালোচনা, প্রশংসা আর প্রশস্তির প্রবন্ধ। তাঁকে পদ্মশ্রী খেতাবে ভূষিত করে ভারত সরকার। অনেকটা পথ তখনও তাঁর পারি দেওয়া বাকি। এরই মধ্যে তাঁর জীবনে নেমে এল এক অন্ধকার।
নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু পাছে পাছে.....
আনন্দা তৈরি হচ্ছিলেন আমেরিকায় দুসপ্তাহের ট্যুরের জন্য। বুকে একটা উপবৃদ্ধি লক্ষ্য করেন। Mammogram করিয়ে চলে যান আমেরিকা। ফিরে এসে দেখেন মুম্বাই বিমান বন্দরে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছেন তাঁর স্বামী। মনে মনে ভাবছিলেন, সতেরো বছরের বিবাহিত জীবনে এত রোমান্স কোথায় ছিল! টের পাচ্ছিলেন একটা কিছু আছে যার হিসেব মিলছে না।
তাঁর বুকের লাম্পটা কর্কটের কামড়। ম্যালিগনান্ট। প্রথমে স্বামীর বুকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। এরপর শক্ত হয়ে নিজেকে তিনটি বিষয় বোঝালেন।
প্রথমত ক্যান্সার তাঁর জীবনের একটি পাতা,গোটা বইটি নয়। দ্বিতীয়ত কিছুতেই এই রোগকে মাথা চাড়া দিতে দেবেন না। এবং সব শেষে তিনি নিজেকে কখনোই এই প্রশ্ন করবেন না যে কেন হল তাঁর ক্যানসার?
চিকিৎসা শুরু হল। সব আঘাত তিনি হাসিমুখে সইলেন। শুধু তাঁর ওঙ্কোলজিস্টকে তিনি বলতেন " আমি নাচ না করতে পারলে মরে যাব।"
ডাক্তার বোঝাতেন কেমোথেরাপি শরীরকে বড় দূর্বল করে দেয়। মানুষ সিঁড়ি বেয়ে উঠতেও হাঁপিয়ে যান। আর তিনঘন্টা ধরে নাচ কেমন করে করবেন আনন্দা? নাচের প্রোগ্রাম থাকলে তিনি কেমোর ডেট পিছোনো নিয়ে জেদ করতেন। ডাক্তার ভাবতেন মাথাটাও বুঝি গেল।
২০০৯ সালের ৭ই জুলাই। সার্জারি দিন তিনি বললেন অপারেশন টেবিলে যাওয়ার আগে মঞ্চে নাচ করতে যাওয়ার মতো করে সেজেছিলেন। টিপ লিপস্টিক কাজল পরে এ যেন আর এক রঙ্গমঞ্চের অন্যরকম নৃত্যনাট্য। সার্জারির পর তিনি ডাক্তারের কাছে জানতে চান কেমন ছিল তাঁর পারফরম্যান্স?
... ধন্য হল ধন্য হল মানবজীবন
অপারেশনের ঠিক দুদিন পর থেকেই আনন্দা ফিরলেন পুরোনো রুটিনে। নৃত্যই সব যন্ত্রণা থেকে মুক্তির স্বাদ দিত। তিনি আবার মেতে উঠলেন তাঁর ছাত্রছাত্রী আর শো করা নিয়ে। শরীরের কষ্টকে তোয়াক্কা না করে ট্যুরের আয়োজন করলেন। কেমোর পর তিনদিন বিশ্রাম নিলে চারদিনের দিন তাঁর স্বামী তাঁকে নাচতে বলতেন। প্রতিপদে ভীষণ সাহস জুগিয়েছেন । বলতেন, কে বলেছে যে অমৃত পানের পর কোনো প্রতিক্রিয়া হয়না, কে বলেছে অমৃতের স্বাদ মিষ্টি? আনন্দা বুঝতেন এ সবই তাঁর মনকে চাঙ্গা রাখার ট্রিকস্।
আনন্দার চেতনার নতুন বিকাশ হল। তিনি নিজের ভিতর দুর্গাকে দেখতে পেলেন। প্রত্যেক নারী একজন দুর্গা হতে পারেন। তাঁর পরিবার, ডাক্তার, বন্ধুরা, কেমোলজিস্ট, ওঙ্কোলজিস্ট,রেডিওলজিস্ট এঁরা সব তাঁর যেন এক একটি হাত। আর সিংহটা? সিংহ হল অন্তরের শক্তি, ধৈর্য ও সহনশীলতা। কতবার দূর্গা বন্দনা মঞ্চস্থ করেছেন। কই এভাবে তো কখনও ভাবেননি।
তাঁর ক্যান্সার নিয়ে TED Talk এই বিষয়ে শ্রেষ্ঠ ভারতীয় TED Talk গণ্য হয়েছে। আজ তিনি ক্যান্সার মুক্ত। মানুষ জানেন আনন্দা বিজয়ী যোদ্ধা। আবার দৃপ্ত ভঙ্গিমায় দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছেন নৃত্যমঞ্চে আর কর্মক্ষেত্রে। বকাঝকা দিচ্ছেন ভুলে ভরা স্যারেদের পৃথিবীকে। তিনি হেসে উঠলেন একটা ঘটনা মনে করে। একবার তিনি উইগ না পরে বেরিয়ে পড়েছিলেন। একজন অফিসার ছুটে এসে বলেন "thirupathy?"। তিনি বলেন,"না, কেমোথেরাপি।"