আমরা কি সত্যিই তোমাদের ভালোবাসি?

আমরা কি সত্যিই তোমাদের ভালোবাসি?

Tuesday July 12, 2016,

6 min Read

ভদ্রা পাঁচমাসের ছোট্ট একটি কুকুরের বাচ্চা। গোটা দেশ এইসময় তাকে নিয়ে আবেগের জোয়ারে ভাসছে। ও আমাকে শেরুর কথা মনে করিয়ে দিল যখন আমি SPCA হাসপাতালে শেরুকে দেখতে গেছিলাম তখন ও আমার দিকে এইভাবেই তাকিয়েছিল। শেরু অসুস্থ ছিল। একটা ছোট ঘরে আরও অনেকগুলো কুকুরের মাঝখান থেকে আমায় দেখে ও ছুট্টে এল। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। ওর দৃষ্টিতে আমি একটি অনুরোধ খুঁজে পেলাম। যেন আমায় বলছে ওকে হাসপাতাল থেকে সেই অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে যেতে যেখানে ও জন্মেছে। আমি ওর ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে ফিরে আসি। শেরুর চোখগুলো আজ ভদ্রার মতই আমায় খুঁজছিল। শেরুর ম্যালিগনান্ট টিউমার ছিল।

image


শেরুরও এরকম গায়ের রং ছিল। ভদ্রার থেকে লম্বা। শেরুর বয়স আমার খেয়াল নেই, তবে ও আমার অ্যাপার্টমেন্টের ভাগিদার ছিল। আমি যখন প্রথম ওকে দেখি, ও বেশ মোটাসোটা ছিল। আমার বাকি দুটো পোষ্যর সঙ্গে, আমার পেছন পেছন ও ঘুরতে যেত। স্বাধীনচেতা শেরু সবসময় নিজের লেজ নাড়ত। আমার ছোট্ট কুকুরগুলো মাঝেমধ্যে ওকে কামড়ে দিত, বদলে শেরু কখনও ওদের আক্রমণ করত না। ও একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটত আর অন্য কোনও কুকুরকে আমাদের ধারেকাছে ঘেঁষতে দিত না। অন্য কুকুররা যদি আমার কুকুরদের দেখে ঘেউঘেউ করত কিংবা বন্ধুত্ব করতে চাইত, শেরু তাদের তাড়া করত। অভিভাবকের মতো পাহারা দিত। অ্যাপার্টমেন্টের কেউ ওকে জ্বালাতন না করলে ও কখনও কাউকে কামড়াতো না।

একদিন শেরুকে আদর করার সময় ওর লোমগুলো আমার রুক্ষ লাগল। আমি তখন বিষয়টিকে গুরুত্ব দিইনি। কিছুদিন বাদে দেখলাম ওর লোম ঝরে যাচ্ছে। আমার পশু চিকিৎসক জানালেন এই সংক্রমণের চিকিৎসা প্রয়োজন। দুধ আর খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে আমি শেরুকে ওষুধ খাওয়াতাম। অল্পদিনেই ভালো ফল হল। নতুন লোমে ওর শরীর ভরে গেল, ও স্বাস্থ্যবানও হয়ে উঠল। একদিন সকালে ওর গলায় একটি ক্ষত লক্ষ্য করলাম। পুঁজরক্তে ভরা ক্ষতটি বেশ বেদনাদায়ক, কিন্তু আমি শেরুকে কখনও কাঁদতে দেখিনি। ক্ষতটির ছবি তুলে ডাক্তারকে দেখালাম। ডাক্তার একটি মলম দিলেন। ব্যাথা থাকলেও শেরু আমায় ওকে ধরতে দিত। ডাক্তার শেরুকে SPCA হাসপাতালে পাঠানোর কথা বললেন। আমি অ্যামবুলেন্স ডেকে ওকে হাসপাতালে পাঠালাম। শেরু ভয় পাচ্ছিল। যেতে চাইছিল না হাসপাতালে।

ভদ্রার কপাল ভালো যে দোতলা থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার পরও সে খুব বেশি আহত হয়নি। পেছনের পায়ের একটি হাড় ভেঙ্গেছে। পিঠে আঘাত তবে তিন সপ্তাহে সে সুস্থ হয়ে যাবে। কেউ জানে না অমানবিকতার এই চূড়ান্ত নিদর্শন দেখিয়ে ভদ্রাকে ফেলে দেওয়ার পর টানা দশদিন কুকুরছানাটি কিভাবে অসহ্য বেদনার সাথে লড়াই করল! দশদিন বাদে যখন ও একটু চলাফেরার যোগ্য হয়েছে তার আগে নিশ্চয়ই খিদেয়, তৃষ্ণায় ছটফট করেছে। কেউ কি একটুও ভেবেছেন ওই যন্ত্রণার দিনগুলো কিভাবে কেটেছে ওর? ছোটোখাটো শারীরিক সমস্যায় আমরা অস্থির হয়ে উঠি। ডাক্তারের কাছে ছুটি। পরিবারের কেউ না কেউ সবসময় আমাদের খাওয়াপরার যত্ন নেন। অথচ এই পশুগুলোর কথা আমরা কেউ ভাবি না।

আরেকটি কুকুর ছিল যাকে আমি রোজ খেতে দিতাম। হঠাৎই সে আমার ফ্ল্যাটে আসা বন্ধ করে দিল। আমি ওকে খুঁজলাম, কোনও হদিশ পেলাম না। একদিন আমার গাড়িতে উঠছি, শুনলাম কুকুরের গোঙানি। আমার গাড়ির চারধারে সে প্রচন্ডভাবে দৌড়চ্ছিল। নেমে এলাম। সেই কুকুরটি। আমি শিষ দিলাম। ওর যন্ত্রণা হচ্ছিল। দেখলাম লেজ থেকে রক্ত পড়ছে। লেজটা কাটা। নিজেকে প্রশ্ন করলাম, এতগুলো মাস পরে ও আমার কাছে এল কেন? ও কি আমার কাছে কোনও চিকিৎসা চায়? নাকি ওর মনে হয়েছিল বিপদে আমি ওকে সাহায্য করব? জানি না। ও তো কথা বলতে পারে না। সবটাই আমার ধারণা।

একদিন রাতে অফিস থেকে ফিরে দেখলাম একটা মেয়ে কুকুর তার ছানাকে নিয়ে আমার দরজার উল্টোদিকে বসে আছে। অনেক কুকুরকেই রোজ খেতে দিই। এর আগে ওদের দেখিনি। কাছে গিয়ে টের পেলাম কুকুরছানাটি নড়ছে না। ওকে ছুঁয়ে বুকের ধুকপুক অনুভব করলাম। অসুস্থ শিশুটাকে দুধ খাওয়ালাম। অনেক কষ্ট করে ছানাটি ওর লেজ দু তিনবার নাড়ালো। মা কুকুরটি কিন্তু আমায় দেখে একটুও ঘেউঘেউ করল না। আমি ডাক্তারকে ফোন করায়, তিনি পরেরদিন সকালে কুকুর ছানাটিকে নিয়ে যেতে বললেন, কারণ তখন অনেক রাত।

পরেরদিন ভোরে ঘুম ভেঙ্গে দরজা খুলে দেখলাম কুকুরছানাটির নিঃশ্বাস পড়ছে না। ওর মা পাহারা দিচ্ছে। কেন সে তার শিশুকে আমার দরজায় নিয়ে এসেছিল এটা ভেবে অবাক হওয়া ছাড়া আর কিই বা করার ছিল? কে ওকে আমার ঠিকানা দিল? কেনই বা ও অন্য কোথাও গেল না? কিভাবে তার ধারণা হয়েছিল যে আমার কাছে কিছু হলেও সাহায্য সে পাবে? আমি ওর ভাষা বুঝি না। কিন্তু আমার পোষা মগু আর ছোটুর সঙ্গে আমি কমিউনিকেট করতে পারি। বুঝি কখন ওদের খিদে পেয়েছে অথবা কখন ওরা খুশি। মগুর পেট খারাপ থাকলে ও রাতে আমায় তুলে দেয়। বোঝায় বাইরে পটি করতে নিয়ে যেতে হবে। দীর্ঘদিনের জন্য বাইরে গেলে আমি ওকে শান্ত থাকতে বলে যাই। বলি যে আমি তাড়াতাড়ি ফিরব। ও যেন কাউকে না জ্বালায়। তবে পথের কুকুরদের সঙ্গে এই যোগাযোগ সম্ভব নয়।

আরেকদিন আমার অ্যাপার্টমেন্টে একজন মহিলাকে দেখলাম বেশ ভয় পেয়ে গেছেন। বললেন আমার পোষা কুকুররা ঘুরঘুর করছে, যদি ওনাকে কামড়ে দেয়। আমার হাসি পেল। একটা সাধারণ ধারণাই আছে যে কুকুর কামড়ায়। আমি যখন ক্লাস থ্রি এ পড়ি আমায় একটি মেয়ে কুকুর কামড়েছিল। কিন্তু সময়ের সাথে ওদের প্রতি আমার ভালোবাসা আরও বেড়েছে। আমি এখন জীবনটা ওদের ছাড়া ভাবতেই পারি না। সব জায়গায় রাস্তায় ওদের সঙ্গে খেলি। ওরা আমি ডাকলেই লেজ নাড়ে। লুধিয়ানার এক পেট্রল পাম্পে এক কুকুর আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করেছিল। আমি ওকে বিস্কুট দিই। রাণি বলে যে কুকুরটা বহু আগে আমায় কামড়েছিল সেও খারাপ ছিল না। ওর খিদে পেয়েছিল তাই আমার হাতের রুটি ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল। ফলে আমায় কামড়ে দেয়। যদি কুকুররা কামড়ায় ই তাহলে শেরু কেন কোনওদিন আমায় কিংবা আমার পোষা কুকুরদের কামড়ে দেয়নি? অথবা সেইসব কুকুরগুলো যাদের আমি খেতে দিতাম? বরং আমার উপস্থিতি ওদের আনন্দ দিত। ওরা লাফাত, ডাকত। আমার ক্ষতি করতে নয়, আমার সঙ্গে খেলতে, আমার প্রতি ওদের ভালোবাসা জাহির করতে। আমি কোনওদিন পশু আর মানুষে বিবাদ দেখিনি।

শেরু ওর শেষের দিনগুলোয় সেই জায়গাটি ছেড়ে কিছুতেই যেতে চাইত না যেখানে ও বড় হয়েছে। আমি ওকে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কে বলতে পারে হয়ত আমার ওকে হাসপাতালে পাঠানোই ওর বাঁচার ইচ্ছেটাকে মেরে ফেলে? আরও কমে গেল ওর আয়ু? হাসপাতালে যাওয়ার পর ও দুসপ্তাহ বেঁচেছিল আর এক বিকেলে শেরু মারা গেল। ডাক্তার শেরুর কথা জানিয়ে আমায় ফোন করলেন। আমার নিজেকে দোষী মনে হচ্ছিল। ওই কুকুরছানাটার জন্যও নিজেকে দোষী লাগছিল যে সেদিন রাতে আমার দরজায় মারা যায়। ওর মার কাছে আমি ক্ষমা চাই। সে তার ছেলেকে আমার কাছে এনেছিল কিন্তু আমি গভীর রাতে তাকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে পারিনি। সেইসব কুকুরগুলোর জন্য আমি দুঃখিত যাদের আমি খেতে হয়ত দিয়েছি তবে নিরাপদ আশ্রয় দিতে পারিনি। তাদেরও সম্মানের সাথে বাঁচার অধিকার আছে। আমাদের আধুনিক উন্নতিশীল সমাজে আমরা কি ওদের সমস্যা, যন্ত্রণা নিয়ে ভাবি? বিশ্বাস করুন, ওরা সবচেয়ে আদুরে প্রাণী। ওরা নিঃশর্তভাবে ভালোবাসা দিতে জানে বদলে মানুষের মতো কিচ্ছু ফেরত চায় না।

আমি এমন কোনও মানুষ দেখিনি যে কুকুরের কামড়ের দোষ দেয় না। আমি অস্বীকার করছি না যে ওরা কামড়ায় কিন্তু শুধু তখনই যখন ওদের বিরক্ত করা হয়, মারা কিংবা ভয় দেখানো হয়। খুব খিদে, তৃষ্ণার সময়ও কামড়ায়। গ্রামেগঞ্জে অন্ধ ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে কুকুরকে খেতে দেওয়া হয়। পানের জল দেওয়া হয়। সেখানে পশু আর মানুষের মধ্যে একটি জৈব সম্পর্ক আছে। কিন্তু শহর কুকুরদের অনাথ করে দিয়েছে। ওদের বাসযোগ্য কোনও নিরাপদ স্থান নেই। রাস্তায় প্রতিকূল পরিবেশে যেকোনও সময় গাড়ি চাপা পড়তে পারে ওরা। আমরা মানুষরা ওদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করি, বর্বরচিত আচরণ করি , আবার আমরাই ওদের দোষারোপ করি!