শান্তভাবে বিহার বুঝিয়ে দিল 'সবার উপর মানুষ সত্য'

শান্তভাবে বিহার বুঝিয়ে দিল 'সবার উপর মানুষ সত্য'

Tuesday November 10, 2015,

5 min Read

(লিখছেন সাংবাদিক রাজনীতিবিদ আশুতোষ)

image


বিহারের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল কি হতে চলেছে, তাই নিয়ে গোটা দেশ জুড়েই উত্তেজনার আবহ ছিল। অনেককিছু নির্ভর করছিল এর উপর। এই নির্বাচন এমন একটা সময় সংঘটিত হল, যখন ভারত গুরুতর সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। বৃহত্তর ভারতের ধারণার সাথে উদারতা, আধুনিকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা বা বহুত্ববাদের যেসমস্ত ধারণাগুলি ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে, সেইগুলিই পড়ে যাচ্ছিল প্রশ্নচিহ্নের মুখে। উদারনৈতিকতার আদর্শ ভারতীয় সমাজে আদৌ বিদ্যমান থাকবে, নাকি সামাজিক পরিসরের দখল নেবে কোনো রক্ষণশীল, গোঁড়া, সাম্প্রদায়িক শক্তি – সংশয় তৈরি হয়েছিল সেই নিয়ে। প্রাণঘাতী আক্রমণ সংঘটিত হচ্ছিল। বাস্তবিকই উদ্বেগ দেখা দিচ্ছিল একে কেন্দ্র করে। কারণ এই প্রথমবার ভারতে এমন হল যে কারুর খ্যাদ্যাভ্যাসের জন্য, কিংবা কারুর সাথে মতে মিলছেনা বলে তাকে হত্যা করা হল।

গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে ভারতের অনেক সমস্যা আছে একথা ঠিকই। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা মনে করি যে এই রাষ্ট্র তার গঠন কাঠামোগত ও অস্তিত্বের সহজাত হিসাবেই ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে লালন করে। এ দেশ বিকশিত হয় তার বহুত্ববাদের উপর ভর করেই। এ দেশ কখনোই সাম্প্রদায়িকতার আদর্শকে ধারণ করেনি। আপোষ করেনি এরকম কোনো শক্তির সাথে যার অস্তিত্ব ভারতের এমত ধারণার পক্ষে ক্ষতিকর। কিন্তু বিগত কয়েকমাস যাবৎ দেখা যাচ্ছে যে রাষ্ট্র হয় নীরব দর্শকের ভূমিকা নিয়েছে, অথবা পক্ষ নিচ্ছে এমন কিছু শক্তির যারা ভারতকে আবার মধ্যযুগে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। ভারত সবসময়ই একটি উদারনৈতিক, সহিষ্ণু রাষ্ট্রব্যবস্থা হিসাবে পরিচিত থেকেছে। এদেশের মত বিবিধ জনগোষ্ঠীর মানুষকে নিয়ে গড়ে ওঠা একটি রাষ্ট্রব্যবস্থায় সফলভাবে গণতন্ত্রের অনুশীলন করার জন্য ভারতবর্ষ সর্বদাই প্রসংশিত হয়ে এসেছে। কিন্তু সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীগুলির যদি দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক প্রতিপন্ন হবার আশঙ্কা বাস্তব হতে দেখা যায়, তাহলে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের মতামত কি, এই প্রক্রিয়ার পিছনে তাঁদেরও সমর্থন রয়েছে কিনা, সেই প্রশ্নের উত্তর জানাটা ভীষণভাবেই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।

বিহারের নির্বাচনী ফলাফল এই প্রশ্নেরই উত্তর দিয়েছে সোচ্চারে। জনমত ভীষণভাবেই স্পষ্ট। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোর পক্ষে ক্ষতিকর কোনোকিছুকেই মানুষ মেনে নেবেন না। ভারত একটি আধুনিক, উদারনৈতিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং এই কাঠামোয় কোনো বদল আনতে দেওয়া যাবেনা। একুশ শতকে অস্বচ্ছতার রাজনীতির কোনো জায়গা নেই। আর এইরকম এক পরিস্থিতিতেই জয় পেয়েছে লালু-নীতিশ জোট। ব্যাপকভাবে বিজয়ী হয়েছেন তাঁরা। কিন্তু তাঁদের সামাজিক ভিত্তি, কাঠামো ও রাজনৈতিক সক্রিয়তার ধরন ভারতের উদারনৈতিকতার আদর্শ, মানবসভ্যতার ইতিহাসে যার ভূমিকা ইতিবাচক অর্থে অত্যন্ত তাৎপর্যময়, তার সাথে সাযুজ্যপূর্ণ। ভারতের সংবিধান নবজীবন দিয়েছে সমাজের এই অংশকেই। দীর্ঘ বহু শতক এই অংশ যেখানে সমান বলে বিবেচিত হতনা, সেখানে মুহুর্তের মধ্যেই, যেন বা কোনো বোতাম টেপার সাথে সাথে সামাজিকভাবে দেশের সবথেকে ক্ষমতাশালী অংশের সাথে সমান বলে গণ্য হচ্ছে। ভারতে পশ্চাৎপদ, দলিত মানুষ সংখ্যায় অনেক বেশি হলেও তাঁরা কখনোই পশ্চাদমুখী কোনো শক্তির প্রতি নিজেদের সমর্থন জ্ঞাপন করেননি। সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা এই অংশ, যারা প্রান্ত থেকে কেন্দ্রে উঠে এসে, সমাজের মূল ধারায় নিজেদের ভাষ্য গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর, বিহারের এই নির্বাচন তাদের জয়কেই সূচিত করেছে।

কেউ লালুপ্রসাদ যাদবকে দেখে হাসতে পারেন। কোনো সন্দেহ নেই যে তিনি যথার্থই একটি ‘ক্লাউন’সুলভ চরিত্র। কিন্তু তাঁর এই ছদ্মরুপের আড়ালে রয়েছে এক বৈপ্লবিক চেতনা, যা স্বর দিয়েছে প্রান্তিক স্তরের মানুষদের। মন্ডল কমিশনের নীতি রুপায়ন হবার পর তিনি সক্রিয় করে তুলেছেন যারা অন্তেবাসী, শোষিত, সমাজেই সেই অংশকে। আমরা, সমাজের উচ্চবর্ণের মানুষরা নিজেদের পূর্ব-ধারণা, পক্ষপাত বশত বাস্তবতাকে দেখতে পারিনি এবং তাঁকে তুছতাচ্ছিল্য করেছি। সমাজের এই শোষিত বর্গের অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামো কিন্তু অসম্পুর্ণ। এবং লালু এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু সমস্যা হয়েছিল এটাই যে তিনি যথেষ্ট দূরদর্শী না হবার কারণে নিজের শ্রেণিকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালী করে তুলতে পারেননি।তিনি শাসন ব্যবস্থার দিকে নজর দেননি। তিনি বৈপ্লবিক চেতনাসম্পন্ন এই প্রান্তিক অংশকে সক্রিয় করে তুলেই সন্তুষ্ট ছিলেন। কিন্তু প্রয়োজন ছিল এমন পরিকল্পনার, যাতে করে এই অংশ সামাজিকভাবে হয়ে উঠত আরো তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু ইতিহাস বোধহয় এ কাজ সম্পূর্ণ করার জন্য বেছে নিয়েছিল নীতিশ কুমারকে।

নীতিশ কুমার এক নতুন মডেলের আমদানি করলেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে জনশক্তির পাশাপাশি সমাজের এই ‘বঞ্চিত’ অংশকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করে তোলা প্রয়োজন। তিনি এমন কিছু স্কিম চালু করলেন যাতে করে সরাসরিভাবে এই অংশ উপকৃত হল। এটাকে মিরাকলই বলা যলে যে দীর্ঘ নয় বছর মুখ্যমন্ত্রী পদে আসীন থাকা সত্ত্বেও ব্যক্তিগত স্তরে কিংবা প্রশাসনিক স্তরে তাঁর কোনো ‘অ্যান্টি ইনকামবেন্সি’ নেই। তিনিই ছিলেন এবারের মহাজোটের মুখ। লালুর উপস্থিতি এবং জঙ্গলের রাজত্বের সাথে তুলনীয় তাঁর প্রশাসনিক অতীতের উপস্থিতি সত্ত্বেও বিহারের মানুষ নীতিশ কুমারের উপর আস্থা রেখেছেন। বিজেপি’র এরকম কোনো মুখ ছিলনা। বরং , উন্নয়নের প্রসঙ্গে প্রচারে চলে আসছিল সাম্প্রদায়িক ইস্যু। মোদী ছিলেন এর নেতৃত্বে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তাঁর কাজের ক্ষতিয়ান বিজেপির প্রতি মানুষের আস্থা তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছে। বিজেপির শাসন নীতিশ কুমারের তুলনায় বেশি ভালো হবে, ব্যর্থ হয়েছে এরকম মতামত গড়ে তুলতে।

বিহারের মানুষ দরিদ্র হতে পারেন, খুব উচ্চশিক্ষিত না হতে পারেন। কিন্তু এখানকার মানুষদের রয়েছে এক বিপ্লবী ঐতিহ্য এবং তাঁরাই সবসময় দিশা দেখিয়েছেন। ইন্দিরার গান্ধীর স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা লড়াইয়ে বিহার সসবসময় সামনের সারিতে থেকে পথ দেখিয়েছে লড়াইকে। লালকৃষ্ণ আদবাণীর সাম্প্রদায়িক রথের যাত্রা এই বিহারে এসেই থেমে গিয়েছিল। বিহার এমন এক জায়গা যেখানে গত ৩০ বছরের মধ্যে কোনো গুরুতর সাম্প্রদায়িক সমস্যা দেখা দেয়নি এবং আরো একবার বিহার এই দিশা দেখাল সারা দেশকে যে, যদি ‘সুপার পাওয়ার’ হিসাবে ভারতকে গড়ে তুলতে হয়, তাহলে ভারতের বহুত্বকে, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে গ্রহণ করতে হবে এবং বঞ্চিত ও প্রান্তিকায়িত মানুষদেরকে সাথে নিয়ে চলতে হবে। মানুষ যদি ভয়ের আবহে বসবাস করে, মানুষের চেতনা যদি মুক্ত না হয়, তাহলে সেখানে কোনো অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। এটাই ছিল বিহারের নির্বাচনের মূল বার্তা এবং আশা করা যাক যে নির্বাচন যেহেতু শেষ হয়ে গেছে, তাই দেশ পরিচালনার দায়িত্ব যাদের হাতে, তারা জনতা যে মতামত প্রকাশ করেছেন এই নির্বাচনের মাধ্যমে, সেটাকে মাথায় রেখে সেই মর্মে কাজ করবেন।