বিনিতার ‘বিন্নিস ফুড’ এখন ব্র্যান্ড

কেউ কি কখনও ভেবেছিল, অঙ্কে দারুণ বিনিতা শুধু রান্না করে নিজের ব্র্যান্ড বানিয়ে ফেলবেন। বিন্নিস ফুড এখন ব্যাঙ্গালুরুতে অতি পরিচিত নাম। আজ আপনাদের এই সংস্থার কর্ণধার বিনিতা জৈনের কাহিনি শোনাবো। বিনিতার লড়াই আর সাফল্যের কাহিনি।

বিনিতার ‘বিন্নিস ফুড’ এখন  ব্র্যান্ড

Wednesday August 19, 2015,

5 min Read

বিনিতা এখন বেঙ্গালুরুর একজন সফল মহিলা উদ্যোগপতি। ঘরে বানানো সস দিয়ে সহজেই যাতে পাস্তা-পিজ্জার মত ইটালিয়ান খাবার বানানো যায় সেটা শিখিয়েছেন বিনিতা। পাস্তা-পিজ্জার মত খাবার আদৌ জাঙ্কফুড নয়,সাধারণ মানুষকে সেটা বোঝান বিনিতা। তবে রান্নাবান্নাকে সম্বল করে বিনিতার উদ্যোগপতি হয়ে ওঠার নেপথ্যে রয়েছে অন্য এক কাহিনী।


বিনিতা জৈন

বিনিতা জৈন


বিনিতার ছেলের বাইরের খাবারে অ্যালার্জি ছিল। তাই বিনিতা তাকে সবসময় ঘরে বানানো খাবারই দিতেন। আর তেমনটা করতে করতে ছেলের জন্য সসও তৈরি শুরু করেন বিনিতা। যারা চাখতো ধন্য ধন্য করত। ঘরোয়া পদ্ধিতিতে তৈরি এই সস বাজারে পাওয়াও কঠিন ছিল। সেখান থেকেই মাথায় খেলে গেল আইডিয়া। এভাবেই ওই সস বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের ভাবনা শুরু করলেন তিনি। তবে বিনিতার মত একজন উচ্চশিক্ষিত মহিলা সস তৈরি করে তা বাজারে বিক্রি করছেন ব্যাপারটায় অনেকেই নাক শিঁটকেছিলেন। তবে সেসবে গুরুত্ব দেননি বিনিতা।

রাজস্থানের আজমেঢ়ে এক মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে বিনিতা। অঙ্কে ভালো। স্বপ্ন দেখতেন স্থপতি হবেন। সে আশা পূরণ হয়নি। তাবলে থেমেও যাননি। অঙ্ক আর কম্পিউটর সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। কলেজে পড়ার সময় থেকেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন,নটা পাঁচটারর চাকরি তাঁর জন্য নয়। বরং নিজের কিছু করার ইচ্ছাই পেয়ে বসেছিল।

ব্যবসায় হাতেখড়ি

স্নাতক হওয়ার পরপরই বিয়ে করে ফেলেন বিনিতা। আর বিয়ের পরই তাঁর জীবনের নয়া অধ্যায় খুলে যায়। স্বামীর কাজের সূত্রে কখনও সখনও ভরতে তো বটেই,অস্ট্রেলিয়া এবং ব্রিটেনে প্রায়শই যেতে হত। বিয়ের পর অন্তত দশবার এই তিন দেশে তাঁকে ঘুরতে হয়েছে। প্রথমবার তিনি যখন অস্ট্রেলিয়া যান,তখন সেখানে গিয়ে শিশুদের দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। পরবর্তী সময় যখন অস্ট্রেলিয়া যান,তখন তিনি একটি বিমা সংস্থায় কাজ নেন। এই ঘনঘন যাতায়াতে নিজেকে শিকড়হীন মনে হত। তবে ক্রমেই তিন দেশের চর্কি কাটা ভালো লাগতে থাকে। তিনি বরাবরই ব্যক্তি স্বাতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই কোলের সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে বিমানে একাই দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়াটা তাঁর কখনও সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়নি। এভাবেই একটানা দুবছর অস্ট্রেলিয়ায় কাটানোর পর এক সন্তানের জন্ম দেন বিনিতা।

প্রথম দিকে সংসার আর সন্তানকে নিয়েই তাঁর দিন কেটে যেত। মা হওয়ার প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করতেন বিনিতা। তাঁর কাছে সন্তানই হয়ে ওঠে একমাত্র অগ্রাধিকার। যদিও,নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ইচ্ছে তখনও শেষ হয়ে যায়নি। ইতিমধ্যে বিনিতা তাঁর ভাইপোর সংস্থায় কয়েক মাসের জন্য কাজ করতে যান। সেখানে তিনি ব্যানার ও লোগো ডিজাইন করা শেখেন। শেখেন,ঠিক কিভাবে একটি পণ্যকে ক্রেতাদের সামনে তুলে ধরতে হয়,কিভাবে ক্রেতাদের সামলাতে হয়। শেখেন বিপণনের কৌশলও।

নিজে হাতে রান্নার মজাই আলাদা

তবে তখনও ‘বিন্নিস ফুড’ তাঁর স্বপ্নের কোনও কোণাতেও ছিল না। বিয়ের আগে কখনও রাঁধেননি বিনিতা। যদিও রান্নাবান্না তাঁকে বরাবরই টানত। বিয়ের পর বিদেশে থাকার সময় প্রথম নিজের হাতে রান্না শুরু করেন। তখনই টের পান যে তিনি ভালই রাঁধেন। এমনকি বিদেশ-বিভুঁইয়ে তাঁর রান্নার প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকত বন্ধুরা। আর তাঁদের কাছ থেকে নতুন নতুন রান্নার উৎসাহও পেতেন তিনি। অস্ট্রেলিয়ায় বেশ কয়েকবার ফুড ফেস্টিভালেরও আয়োজন করেছিলেন। এভাবেই বিনিতা লক্ষ্য করতে থাকেন,রান্নার প্রতি তাঁর ঝোঁক বাড়ছে। ওঁকে রান্না নিয়ে নিরন্তর পরীক্ষানিরীক্ষায় উৎসাহ জোগাতেন ব্রিসবেনের এক বন্ধু। সেও এক দারুণ রাঁধুনি। ব্রিসবেনে রেস্তোরাঁ চালান। যদিও,ব্রিটেনে থাকার সময় বেশিরভাগটাই বিনিতার ঘরে কাটত,কেননা তাঁর দ্বিতীয় সন্তান তখন খুবই ছোটো। স্বামী কাজে ব্যস্ত থাকায় সন্তানদের মানুষ করার সমস্ত দায়িত্বটা ছিল তাঁর কাঁধে। ঘরগেরস্থালির কাজ তো ছিলই,সেইসঙ্গে সন্তানদের স্কুলে নিয়ে যাওয়া,তাদের গানের স্কুল-টেনিস শেখাতে নিয়ে যাওয়া—সবই একাহাতে করতেন। ভালোও লাগত এসব করতে। দিনভর কাজে ডুবে থাকার মধ্যেও এক অনাবিল আনন্দ পেতেন বিনিতা। সেখানেও অনেক বন্ধু পেয়েছিলেন। দিনের শেষে তাঁদের সঙ্গে আড্ডা,তাঁর সারাদিনের ক্লান্তি দূর করে দিত।

নিজের হাতে স্টিয়ারিং

গাড়ি চালানোও ছিল বিনিতার বরাবরের পছন্দ। ভারতে গাড়ি চালানো শিখলেও,সেইসময় তাঁর কোনও গাড়ি ছিল না। তবে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পর তিনি প্রথম একটি টোয়োটা করোলা কেনেন। ব্রিটেনে একটি বিএমডব্লিউ ও একটি নিশান ছিল। আর স্টিয়ারিংয়ে হাত দিলেই সামনের রাস্তা তাঁকে হাতছানি দিত। অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন—যেদেশই হোক। বন্ধুদের সঙ্গে কোথাও যাওয়ার হলে স্টিয়ারিংয় তিনিই সামলাতেন।

শিখতে ভালো বাসেন বিনিতা

অস্ট্রেলিয়ায় থাকার সময় বিনিতা তাঁর দুই সন্তানকে গান শেখান। ওইসময় বড় ছেলের আব্দার মেনে তিনি নিজেও বাঁশি বাজানো শেখেন। তবে দীর্ঘদিন রেওয়াজ না থাকায় এখন আর বাঁশিটা তাঁর ঠিক বাজে না। তবে এখনও মাঝেমধ্যে পছন্দের বাঁশিকে সঙ্গী করতে ইচ্ছে জাগে তাঁর। শেখায় বরাবরই আগ্রহ ছিল বিনিতার। তা খুব কাছের বন্ধু হোক কিংবা সম্পূর্ণ অপরিচিত কেউ। তাঁর শেখার ক্ষেত্রে কখনও অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি।

পথের ধারে ছড়ানো প্রেরণা

ব্রিটেনের ছোট্ট শহর ইপসউইচ-এ থাকার সময় এক মহিলাকে রাস্তার ধারে ছোট্ট একটি স্টলে ডোনাট বানাতে দেখতেন। তাঁর একা হাতে ডোনাট বানানো ও বিক্রি করা দেখতেন। আর ওই মহিলার মু‌খেই বিনিতা কোনও একসময় শুনতে পেয়েছিলেন,নির্ভরশীলতা মানুষকে দুর্বল করে তোলে। ক্রমেই ওই ডোনাট বিক্রেতার সঙ্গে আলাপ জমিয়ে ফেললেন বিনিতা। বিনিতার কথায়,এত ভাল ডোনাটের স্বাদ গোটা বিলেত তো বটেই,কোথাও পাননি তিনি। ওই মহিলা অত্যন্ত ভালবেসে ডোনাট তৈরি করতেন। বিনিতার মতে,এই ভালবাসা দিয়ে রান্না করাটাই ডোনাটগুলির স্বাদ বাড়িয়ে দিত। বিনিতা নিজেও বিশ্বাস করেন,রাঁধতে গেলে খানিকটা অন্তর দিয়েই রান্না করা উচিত। নয়তো সেই রান্না বিস্বাদ হয়ে যায়।

সুন্দর ব্যবহারই বিপণন কৌশল

অস্ট্রেলিয়া-ব্রিটেনে থাকাকালীন আরেকটা বিষয় লক্ষ্য করেছিলেন বিনিতা,সেটা সেখানকার ক্রেতা-বিক্রেতা সম্পর্ক। হাজারো দুশ্চিন্তা কিংবা চাপের মধ্যেও,সেখানকার বিক্রেতারা ক্রেতাদের সঙ্গে যেভাবে নম্র ব্যবহার করেন,তা দেখে খানিকটা অবাকই হয়েছিলেন বিনিতা। এমনকি সব্জীবাজারেও বিক্রেতারা যেভাবে একজন ক্রেতার ভাল-মন্দের খোঁজ নেন,তা তাঁকে বিষ্মিত করেছিল। সেইসঙ্গে বিষয়টি থেকে শিক্ষাও নেন তিনি। সৃষ্টি করেন নিজস্ব বিপণন কৌশল।

বিন্নির নিজস্ব টিম


image


যদিও,ব্যবসার শুরুতে উৎপাদন থেকে বিপণন সমস্ত কিছুর পাশাপাশি ঘরসংসার সামাল দেওয়াটা কঠিন হয়ে উঠেছিল। যার জেরে ক্রমশ হতাশ হয়েও উঠছিলেন। পরিস্থিত সামাল দিতে নিজেই এর উপায় বেছে নেন। গড়ে তোলেন নিজের টিম। চাপটা ক্রমশ হালকা হতে থাকে। সেইসময় আয় খুব একটা বেশি না হলেও, আত্মবিশ্বাসের গ্রাফটা ক্রমশ বাড়তে থাকে বিনিতার। ওইসময়‌টা শুধু রান্নাবান্না নয়, এক বন্ধুর স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাতেও কাজ করতেন। তবে,এখন আর কোনও অতিরিক্ত সময় নেই তাঁর। একটা সময় বই পড়ে দিন কাটালেও,এখন আর তাঁর সেই সময় কোথায়!

তাঁর এমন একটি পরিবারে বেড়ে ওঠা,যেখানে পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে সবাইকে সমান মনে করা হত। এজন্য নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন বিনিতা। তবে নিজেকে কখনও ব্যতিক্রমী মনে করতে চান না তিনি। তাঁর বিশ্বাস, ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে সমান সুযোগ পেলে, যেকোনও কারও পক্ষেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করাটা সহজকাজ। যদিও, একজন মহিলা অর্থ আয় করলেই তাঁর সম্মান প্রাপ্য তেমনটা বিশ্বাস করেন না বিনিতা। তাঁর মতে, বাড়ির বাইরে কাজের মত, যেসমস্ত মহিলা শুধুই সংসার সামলান তাঁরাও সমানভাবে সম্মান প্রাপ্য। এই বিশ্বাসকে পুঁজি করেই এগিয়ে যেতে চান বিনিতা।