কথায় আছে বিশ্বাস থাকলে "পঙ্গুং লঙ্ঘতে গিরিং"। এখানে বিশ্বাস মানে দেবদ্বিজে ভক্তি নয়, আত্মবিশ্বাস। তাই ছিল মণি রজার্সের। ভালো নাম মণিকান্দান কুমার। তিনি প্রথম ভারতীয় প্যারা ক্লাইম্বিং চ্যাম্পিয়ন। শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে পাহাড় চড়েছেন মণি। সাফল্যের সেই পাহাড়ে মণির আত্মবিশ্বাস কয়েকশ গুণ উচ্চতায় উঠে গিয়েছে। আঠাশ বছরের ছেলেটি দেখিয়ে দিয়েছে পোলিওর চেয়ে মনোবল কত বেশি শক্তিশালী।
মণি গরিব ছুতোরের ছেলে। লেখাপড়া থেকেও খেলাধূলা বেশি টানত মণিকে। একদিন এক পাথরের দেওয়াল টপকাতে গিয়ে তিনি খেয়াল করেন এই খেলাটি বেশ ভালো লেগে গেছে তাঁর। ডান পায়ে পোলিও নিয়ে ষোলো বছরের মণির রক ক্লাইম্বিং এর যাত্রা শুরু। সাল ২০১২। রামনগরের রক ক্লাইম্বিং ক্যাম্প। দশম শ্রেণীর পর রোজ ক্লাইম্বিং করতেন। নেশার মতো। মণির কোনো স্পেশাল ট্রেনার ছিল না। অন্য ক্লাইম্বারের ট্রেনিং লক্ষ্য করতেন। রামনগরম,হামপি কিংবা বাদামির পাথরের পাহাড় হোক অথবা কান্তিরাভা স্টেডিয়ামের নকল দেওয়াল, তিনি অনায়াসে টপকে যেতেন। মণি একটা ক্যালিপার (নকল পা) ব্যবহার করেন। যদিও কোনো শারীরিক বাধাই তাঁর পাথরের মতোই কঠিন ব্রত ভাঙতে পারেনি।
প্যারিসে ওয়ার্ল্ড প্যারা ক্লাইম্বিং চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেবার সুযোগ এল মণির। টাকা জোগাড় করতে মণি দিনরাত পরিশ্রম করেছেন। কাঁটিরাভা স্টেডিয়ামে অন্য ক্লাইম্বারদের ট্রেনিং দিতেন। স্পনসরশিপ জোগাড় করার কঠিন লড়াই, কঠোর শ্রম আর নিষ্ঠার পুরস্কার পেলেন। রাজ্য সরকার,'The Thimmaiah National Adventure Academy' এবং কিছু শুভাকাঙ্খী বন্ধু আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়ান। স্বপ্ন বাস্তব রূপ পেলে কি অনাবিল আনন্দ হয়! মণি সেই আনন্দের স্বাদ পেলেন। প্রথম দেশের বাইরে পা রাখা। তিনি ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করছেন। বিদেশী ক্লাইম্বারের সঙ্গে ট্রেনিং, আর 'আইফেল' টাওয়ার দর্শন। 'রথ দেখা কলা বেচা' দুইই হল তাঁর। Arcteryx স্টোরে খেলার জিনিস পাওয়া যায়। ঢুঁ মারলেন সেখানেও। বিদেশী ট্রেনিং কতটা পৃথক জানতে চাওয়ায় মণি বলেন,বিদেশে অনেক উন্নত পদ্ধতিতে ট্রেনিং হয়। ওখানে ওঁরা ক্লাইম্বিং খুব সোজা করে বোঝান। ভারতের এখনও অনেক কিছু নতুন শেখা বাকি। একদিন ক্লাইম্বিং করে উঠলেন 'আইফেল' টাওয়ারের মাথায়। সেখান থেকে দেখলেন কেমন করে রাঙা রবি ঢলে পড়ে ফ্র্যান্সের স্বপ্ননগরীর কোলে।
তবে মণি নিজেই উদীয়মান সূর্য। ২০১২ তে ওয়ার্ল্ড প্যারা ক্লাইম্বিং চ্যাম্পিয়নশিপে মণি ভারতকে স্বর্ণশিখরে বসিয়েছেন। প্রথমবার জেতার পর মণি বলেন, তিনি এই ইতিহাসের অংশ হতে আপ্রাণ চেয়েছিলেন। দীর্ঘ লালিত স্বপ্ন। প্রথম প্রথম চ্যাম্পিয়নশিপ জিততে ফ্র্যান্স যাবেন,স্পনসর পাবেন,এসবই অলীক কল্পনাই লাগত। পরের বছর ফ্রান্স এবং লন্ডনে দুবার তিনি রূপো জেতেন। গত বছর তিনবার Gijon Spain, Sheffield London এবং World Para-climbing Championship-এ রূপো জেতেন মণি। ২০১২-র অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে মণি জানালেন,সেইবার স্পনসর পেতে আর অসুবিধা হয়নি। প্রতিযোগিতার রুটগুলো দারুন চ্যালেঞ্জিং ছিল। মণি দেশকে গর্বিত করার তাগিদে নিজের সবচেয়ে ভালোটুকু দিয়ে লড়াই করেছেন। জেতার মুহূর্তটা ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়।
মণি আজ সর্বজনবিদিত। ক্লাইম্বিং তাঁর জীবন। তাঁকে সব দিয়েছে ক্লাইম্বিং। অসাধারণ পারফরম্যান্স তাঁকে বিখ্যাত করেছে Association for People with Disabilities, Rotary Club, BEL, Fame India এবং আরও অনেকের কাছে। ২০০৮-এ Indian Mountaineering Foundation তাঁকে রুট নির্ধারক ঘোষণা করে। তিনি ভবিষ্যতে আরও ইন্টারন্যাশানাল প্রতিযোগিতা জিততে চান। লক্ষ্য পরের বছরই 8a+ উচ্চতায় ওঠার। শেষে মণি জানালেন, তিনি দেশে ক্লাইম্বিং মিডিয়া বানাতে চান। ভালো দেশীয় ক্লাইম্বার যেন অর্থ আর স্পনসরশিপের অভাবে না ভোগেন। ইওর স্টোরি মণি রজার্সকে অনেক শুভেচ্ছা জানায়।
(লেখা সিন্ধু কাশ্যপ, অনুবাদ এষা গোস্বামী)