রাজমিস্তিরির জোগাড়ি কিভাবে হলেন MMR Group এর কর্ণধার!

রাজমিস্তিরির জোগাড়ি কিভাবে হলেন MMR Group এর কর্ণধার!

Wednesday May 11, 2016,

6 min Read

মধুসূদন রাও। শুধুমাত্র পরিশ্রম দিয়েই তৈরি করেছেন এক অদ্ভূত সাফল্যের কাহিনি। বাবা ছিলেন শ্রমিক। মা বিড়ি কোম্পানির দিন মজুর। দারিদ্র, ক্ষুধা, এসব শব্দের সঙ্গেই আজন্ম পরিচয় ছিল ছেলেটির। বাবা-মাকে দেখেছেন আঠারো ঘন্টা করে কাজ করতে। দিনরাত হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পরও যে সামান্য টাকা রোজগার করতেন বাবা-মা তা দিয়ে দুবেলা আহার জুটত না। আর কোনও দিন যদি কাজ করতে না যেতে পারতেন তাহলে শুধু জল খেয়ে ঘুমিয়ে পরতে হতো। দশজনের বিশাল পরিবার। আট ভাইবোন। মধুসূদন রাও পঞ্চম। সকলের পরনেই নোঙরা, ছেঁড়া জামাকাপড়। খালি পা। স্বপ্ন দেখত ছেলেটা। বড়লোক হওয়ার নয়। ২০টি সংস্থার মালিক হওয়ারও নয়। আলিশান বাড়ি, ফিয়াট গাড়ির স্বপ্ন নয়। স্বপ্নে দেখত দুবেলা পেটপুরে খেতে পাচ্ছে রোজ, পরতে পারছে ধবধবে জামা। পায়ের তলায় চটি। ও খালি ভাবত বাবা মা ঠিক কী করেন? কেন গ্রামের আর পাঁচটা লোক পাকা বাড়িতে থাকে আর ওরা থাকে ঝোপড় পট্টিতে?

image


ধীরে ধীরে যত বড় হল ছেলেটা। বুঝতে পারলো বাস্তব। ওরা গরীব। বাবা কোনও এক জমিদারের ক্ষেতে দিন মজুর। অভাবের তাড়নায় মায়ের সঙ্গে বড়দিকেও যেতে হয় বিড়ি শ্রমিকের কাজ করতে। ওরা দলিত পরিবারের ছেলেমেয়ে। হাঁটুর ওপর আউঠ্যা করে ধুতি পরাটাই ওদের ভবিতব্য। উঁচু জাতের মানুষের মোকাবিলা করার কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারত না ওরা। অসম্মানের জীবন, দারিদ্রের যন্ত্রণা, এসব থেকে মুক্তির কোনও রাস্তা ছিল না। অনেক কষ্ট করে আট সন্তানের মধ্যে মাত্র দুজনকেই স্কুলে ভর্তি করতে পেরেছিলেন বাবা মা। এই দুজনের একজন মধুসূদন। শিক্ষকদের পছন্দের পাত্র।

লেখাপড়ায় ভালো ছিলেন। এবার শুধু খাওয়া পরার নয়, জীবনে কিছু করে দেখাবার স্বপ্নও দেখতে শুরু করলেন মধুসূদন। দ্বাদশ শ্রেণীর পর পলিটেকনিক এবং ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং। তা স্বত্তেও চাকরি পেলেন না। শুরু হল অন্য লড়াই। বাবার মতোই মজদুরি করলেন দিনের পর দিন। ওয়াচম্যানের কাজ করলেন বছরের পর বছর। হঠাৎ একদিন সাহস পেয়ে বসল ওনার। স্বপ্ন দেখলেন ব্যবসায়ী হবেন। লোকের দোরে দোরে ঠোক্কর খেলেন। অনেক লড়াই, অনেক যন্ত্রণা সহ্য করে, দিনরাত মেহনত করে, দাঁড় করালেন ওনার প্রথম সংস্থা।

হার না মানা সেই ছেলেটি মন্নম মধুসূদন রাও। আজ তিনি সাফল্যের সপ্তম স্বর্গে বাস করেন। ২০ টি সংস্থার মালিক দেশের তাবড় উদ্যোগপতিদের রোল মডেল। আক্ষরিক অর্থেই ও গল্পটা "Rag to Rich story"। মধুসূদন রাওের সংস্থা MMR group-এর ছত্রছায়ায় চলছে আইটি, টেলিকম, ইলেকট্রিক্যাল, মেকানিক্যাল, ফুড প্রসেসিং এর মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রের নানান সংস্থা। সবগুলোই চলছে দুর্দান্ত সাফল্যের সঙ্গে।

সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে মধুসূদন রাও শোনালেন তাঁর লড়াইয়ের কাহিনী। বলছিলেন জীবনের মোড় ঘুরিয়েছিলেন সরকারি সোশাল ওয়েলফেয়ার হোস্টেলের ওয়ারডেন লক্ষ্মী নারসোয়া। বড় দাদা মাধব আর মধুসূদনকে হোস্টেলে ভর্তি করানোর জন্য বাবাকে রাজি করিয়েছিলেন ওই ওয়ারডেন মহিলা। তাতে দুবেলা দুমুঠো খাবারের চিন্তা আর থাকল না। বরং তিনবেলা খাবার পেতেন মধুসূদন। যদিও খুব খারাপ খাবার কিন্তু তিনি কোনওদিন অভিযোগ করেননি। ভালো নম্বর পাওয়ার জন্য প্রেরণা দিতেন লক্ষ্মী। শিক্ষকদের কখনও নিরাশ করেননি মধুসূদন। চিরকাল এক থেকে পাঁচের মধ্যে থেকেছেন। দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত দুর্দান্ত ফল। দাদা মাধব ভর্তি হলেন B.Tech -এ। ভাইকে পরামর্শ দেন পলিটেকনিক পড়বার কারণ তখন পলিটেকনিক পাশ করলে চাকরি পাবে এমন নিশ্চয়তা ছিল। বড়দের কথামতো তিরুপতির ভেঙ্কটশ্বর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পলিটেকনিক পাশ করেন। পরিবারের সকলের অনেক আশা চাকরি পাবেন মধুসূদন। তাঁর মাইনের দিকে তাকিয়ে গোটা পরিবার। কিন্তু দুর্ভাগ্য! বিভিন্ন কোম্পানিতে আবেদন করা স্বত্তেও, অগুণ্তি ইন্টারভিউতে বসা স্বত্তেও, একটিও চাকরি জোগাঢ় করতে পারলেন না মধুসূদন। কেউ নাকচ করলেন অশিক্ষিত পরিবার এই অজুহাতে, কেউবা বললেন গ্রামের দেঁহাতি, আর কারও চাই রেফারেন্স। মদ্দা কথা চাকরি হলো না।

এবার? মজদুরিই পড়ে রইল একমাত্র রাস্তা। মেজভাই হায়দরাবাদে রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। শিক্ষিত মধুসূদন চলে গেলেন সেখানে। জোগাড়ির কাজ দিয়ে শুরু করলেন। তখন দিনে পঞ্চাশ টাকা করে পেতেন। খোঁজ নিয়ে জানলেন রাতে কাজ করলে ১২৫ টাকা পাওয়া যায়। সেই থেকে রাতে ওয়াচম্যানের কাজ শুরু করলেন। এইভাবে দিনরাত এক করে সংসারের জোয়াল টানার প্রস্তুতি শুরু করলেন।

একদিন হলো কি, এক ইঞ্জিনিয়রের নজরে পরে গেলেন মধুসূদন। একটি টেলিফোন পোস্ট পোঁতার পদ্ধতি দেখেই ইঞ্জিনিয়রের মনে হল এই লোকটি শিক্ষিত। কেননা, মধুসূদন মাপঝোক করে, অঙ্ক কষে, কাজ করছিলেন। এগিয়ে এলেন। জানতে চাইলেন পরিচয়। সব শুনে অফার দিলেন, "চাকরি করবে?" হাতে যেন স্বর্গ পেলেন রাও। হাতপা ধুয়ে ওই ইঞ্জিনিয়রের সঙ্গে চলে গেলেন ওঁর দপ্তরে। ইন্টারভিউ হবে। কিন্তু তার আগেই ওই দপ্তরে ঠিকাদার আর উপঠিকাদারের মধ্যে কথা কাটাকাটি চোখে পরে গেল তাঁর। এই সুযোগ। উপঠিকাদারের কাজটা ঠিকাদারের কাছ থেকে পেতে চাইলেন। বললেন তিনি পারবেন এই কাজ। অদ্ভূতভাবে পেয়েও গেলেন। ফলে ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরি পাওয়াটা ভেস্তে গেলেও ব্যবসায়ী হওয়ার একটি সুযোগ পেলেন মধুসূদন রাও।

কিন্তু কাজ পেলেই তো হল না। লোককে কাজে লাগাবার জন্য প্রয়োজন অর্থের। কম করে নগদ পাঁচ হাজার টাকা লাগত। একে-তাকে অনেক বলেছেন। নিজের পরিবারের লোকজনের কাছেও গিয়েছিলেন। কি আশ্চর্য ব্যাপার, তাঁর এক বোন সাকুল্যে ন'শ টাকার জোগাড় করে দেন। সেই টাকা নিয়েই ঠিকাদারের কাজ শুরু করেন মধুসূদন। শ্রমিকদের রাজি করান তাঁর সঙ্গে কাজ করতে। আর তাতেই কেল্লা ফতে। কাজের প্রথমদিনেই পেয়ে গেলেন ২০,০০০ টাকা। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। তাঁর কাজে খুশি হয়ে একবার অ্যাডভান্স এক লাখ টাকাও দিয়ে দিলেন ঠিকাদার। বহুদিন পর সসম্মানে ফিরে এলেন গ্রামে। এত টাকা একসাথে জীবনে কখনও চোখে দেখেননি তিনি। বাবা মা ভাই বোন সকলের মুখে এক প্রশ্ন, এত টাকা এল কি করে? ওই টাকায় তাঁর এক বোনের বিয়ে দিলেন।

সবকিছু ভালোই চলছিল। কিন্তু জীবনের সবথেকে মোক্ষম শিক্ষাটা পেলেন সেদিন, যেদিন বিশ্বস্ত লোকজন তাঁর সঙ্গে প্রতারণা করল। কোম্পানি ভেঙ্গে চৌচির। সাথে সাথে থমকে গেল স্বপ্ন। জীবন অন্য খাতে বইছিল। অগত্যা চাকরিই করতে শুরু করেন মধুসূদন।

বিয়ে করলেন। স্ত্রী পদ্মলতার সঙ্গে চুক্তি হল আর যাই করো বাপু ব্যবসা করতে পারবে না। কিন্তু ব্যবসা ই মধুকে টানছিল। তাই স্ত্রীকে না জানিয়ে খুলে ফেললেন এক সংস্থা। একদিন বাড়িতে ব্যবসা সংক্রান্ত একটি চিঠি পদ্মলতার হাতে পড়ায় ধরা পরে গেলেন তিনি। খুব অশান্তি। শেষ পর্যন্ত স্ত্রীকে বোঝাতে সক্ষম হলেন। বললেন, তিনি নিজে ২১,০০০ টাকার চাকরি করেন, স্ত্রী ১৫,০০০ টাকার। পরিবারের মাসিক খরচ প্রায় ৩০,০০০-৩২,০০০ টাকা। স্ত্রীকে বললেন ব্যবসা করার অনুমতি দিলে মাসে অন্তত তিন লাখ টাকা রোজগার করে এনে দিতে পারবেন। আর অসুবিধে হয়নি। পরবর্তীকালে এই পদ্মলতাই যোগ্য জীবন সঙ্গীনি রূপে প্রতি পদক্ষেপে সঙ্গে থেকেছেন মধুসূদনের। ব্যবসায় অনেক লাভের মুখ দেখেছেন তিনি, এই স্ত্রীর তাঁর জীবনে অস্তিত্বের জোরে। 

বাকিটা এক বিশাল সাম্রাজ্য গঠনের ইতিহাস। একের পর এক পালক জুড়ে গেল তাঁর মুকুটে। এক থেকে ২০টি সংস্থার সাম্রাজ্য গড়ে ফেললেন মধুসূদন রাও। বলছিলেন পরিবারের সবাই এখন ভালো আছেন। কেউ আর ঝুপড়িতে থাকেন না। সবার পাকা বাড়ি। হাতে হাত লাগিয়ে সবাই মিলে সামলাচ্ছেন তাঁর রাজত্ব।

এতকিছুর পরেও মধুসূদন কিন্তু নিরলশ। আঠারো ঘন্টা অক্লান্ত পরিশ্রম আজও করেন তিনি। তাঁর নিরক্ষর দিনমজুর বাবা মা তাঁর আইডল। আর তিনি আইডল দেশে বিদেশে ছড়িয়ে থাকা অগণ্য স্বপ্নশীল মানুষের। থেমে থাকার পাত্র নন মধুসূদন রাও। বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে দলিত উদ্যোগপতিদের বণিক সভার প্রেসিডেন্ট চান গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে থাকা পিছিয়ে থাকা যুবকদের প্রশিক্ষণ দিতে,যাতে তাঁরা কাজ পান এবং তাঁর মতো ঘুরে দাঁড়াতে পারেন।