বছরভর ভবঘুরে জীবন কাটানোর অভিজ্ঞতা

বছরভর ভবঘুরে জীবন কাটানোর অভিজ্ঞতা

Tuesday January 12, 2016,

7 min Read

বছরখানেক আগে আমার যা কিছু ছিল সব বিদায় করলাম। তারপর থেকে একটা ব্যাগেই চালিয়ে নিতে শুরু করলাম। আর কিছুদিন পর বাড়ি ছাড়লাম। নিজের ইচ্ছেমতো যেকোনো জায়গায় থাকি। রুম শেয়ারিং সার্ভিস ব্যাবহার করি।

image


নি নাওয়ের শতেক নাও। এই দর্শনে বিশ্বাস করি। তাই আমার কোনও গাড়ি নেই। ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকা তো দূরের কথা। কোনও বইপত্রই ক্যারি করি না। যা পড়ি সব আমার কিন্ডলে থাকে। সরি বলতে ভুল করলাম, একটা বই আছে। লাইফ অফ পাই। এটা আমি একজনের থেকে চুরি করেছিলাম। ওটাই একমাত্র। আমি একটা জায়গায় এই বইটা পড়া শুরু করেছিলাম। তারপর ওখানে থাকাকালীন বইটা শেষ করতে পারিনি। তাই ওই বইটা রাখার ইচ্ছে জাগল। তবে বইটা আর শেষ করে ওঠা হয়নি।

আমার কোনও মেডিক্যাল ইনসিওরেন্স নেই। গত তিরিশ বছরে আমার ডাক্তার খানার চৌকাঠও পেরোতে হয়নি অবশ্যি। খামোখা কেন মেডিকেল ইনসিওরেন্স করতে যাব বলুন তো? একজন আমায় বলেছিল এটা বেআইনি কাজ হয়ে যাচ্ছে।ঠিক আছে আগে তো ধরুক। আমার দুটো সোয়েটার আছে।কদিন অন্তর আমাকে দোকান থেকে টি শার্ট আর আন্ডারওয়্যার কিনতে হয়। দুজোড়া প্যান্ট আর দুটো জামায় দিব্যি চালিয়ে নিচ্ছি।

তবে সেসব জামাকাপড় মাঝে মধ্যেই ময়লা হয়ে যায়। লোকজন বিরক্ত হয়। যখন কোথাও রাত কাটাই,‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌ সে জায়গাগুলো ওয়েল ফার্নিশড থাকে। তাই আমার খাট,আসবাব,চাদর কোনও কিছুই লাগে না।অন্যের জিনিস দিয়েই আমার বেশ চলে যায়।

কোনও দিন খাবারের অর্ডার দিই। আবার অনেক সময় দোকান থেকে নিয়মিত খাবার কিনি।কোনও দিন জান্ক ফুড কিনি না।ফলে বাড়তি খাবারও থাকে না।গত ছমাসে আমার ১০ থেকে ১৫ কিলো ওজন কমেছে।

এভাবেই আমার বেশ কেটে যাচ্ছে।কোনও জান্ক ফুড খাই না।দিনে দুবারের বেশ খাই না।ডায়েট মানে আমার কাছে ওজন কমানো নয়।শুধু স্বাস্থকর খাবার খাওয়া।পেটে বাড়তি খাবার রাখি না।

লেখার জন্য একটা ছোট্ট ল্যাপটপ আছে।না লিখলে ল্যাপটপও লাগত না।মোবাইল ফোন দিয়েই চলে যেত। দিনে এক দুবারের বেশী ফোন লাগে না।তবে মাঝে মধ্যে টেক্স্ট চালাচালি করি।আমার ফোন নাম্বার ২০৩-৫১২-২১৬১।

আমার কোনও ঠিকানা নেই,কেউ জানেও না আমি কোথায় আছি। এভাবে দিন কাটিয়ে ভাল মন্দ দু'ধরনের জিনিসই শিখেছি।

১) বৈরাগ্য জরুরি...

এর জন্য কোন জিনিসের সঙ্গে আমার সম্পর্কের ধরণ বদলে গেছে। আমি দেখেছি বেশিরভাগ লোকেরা তাদের কাছে কি আছে,সেই অনুযায়ী তাদের জীবন পাল্টায়।তাদের ফার্নিচার,ঘরের সাজসজ্জা,শিল্পসামগ্রী তাদের জীবনে প্রভাব ফেলে। যেভাবে তাঁরা তাঁদের ছবি বইপত্রের যত্নআত্তি করে সবকিছুই। লোকজন নিজের জিনিসপত্রের সঙ্গে নিজের ব্যাক্তিসত্ত্বাকে গুলিয়ে ফেলে। কখনও তারা যা হতে চায় তার প্রভাব পড়ে। আবার কখনও তারা যেরকম সেরকম তারই প্রতিফলন ঘটে।কখনও আবার এই দুইয়ের টানাপোড়েনেই মানুষ আটকে যায়।

তবে আমি এসবের কিছুই করি না। আমার জিনসপত্রের উপর কোনও টান নেই।আমার কিছুই নেই। আমি অল্প সময়ের জন্য অন্যের জিনিস ধার করি। প্রয়োজন ফুরলে সব ছেড়েছুড়ে বেড়িয়ে যাই। কয়েক সপ্তাহ পর পর বেড়িয়ে পড়ার জন্য নতুন কিছু কিনতেও পারি না। শুধু নতুন জায়গার ছবি মনে এঁকে নিই।

২) অল্প মানেই সস্তা নয়

অনেকের ধারনা অল্প জিনিসে জীবন কাটালে তারা টাকা বাঁচাতে পারতো। লং রানে এটা সম্ভব হলেও হতে পারে। তবে আমি বেশির ভাগ মানুষ যা কেনে তা কিনি না। তবে কখনও কখনও ঘুরে বেড়ানোতেও খরচ আছে। আর নতুন জামাকাপড় খাবার কিনতেও টাকা লাগে। কিন্তু গত ৪০ বছরে খাবার,জামাকাপড়ের দাম আর পরিশ্রমের মূল্য অনেক কমেছে। কিন্তু ইনস্যুরেন্স, পড়াশুনোর খরচ বাড়ির দাম এসব বেড়েছে।

আমার মূল খরচটা হয় যখন নতুন কোনও অভিজ্ঞতার স্বাদ নিতে চাই।

এছাড়া আমি কিছুই কিনতে পারি না। কারণ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ঘুরে বেড়ালে আপনি বাড়তি জিনিস কিনতে পারবেন না।

৩) লোকজনের সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেনের দরকার হয় না

আমি যেহেতু Airbnb-র মারফত ঘর বুক করি। তাই আমায় লোকজনকে ডিল করতে হয় না। কোনও জমির মালিক, দালাল, বোর্ডার, বাড়িওয়ালা এসবের ঝন্ঝাট নেই। কোনও একটা জায়গায় চাবি রাখা থাকে। খুঁজে নিয়ে ঢুকে পড়ি। আর তারপর যেখানকার চাবি সেখানে রেখে আবার বেরিয়ে পড়ি।

৪ ) প্রকৃত বন্ধু পাওয়া যায়

যেখানে থাকি সেখানকার কোনও কিছুই আমার নয়। সেখানকার কোনও কিছুতেই আমার মালিকানা নেই (এখন যেখানে আছি আমার সামনে একটা ন্যুড নাওমি কাম্পবেলের ছবি আছে। ছবিটার মালিক আমি না হলেও ওটা দেখতে কোনও বাধা নেই)। এখানকার বেশিরভাগ জিনিস আমি ব্যাবহারও করি না।আসলে আমি জানিনা এর বেশির ভাগ জিনিস কোন কাজে লাগে। তবে যখন বন্ধু বান্ধবদের ডাকি, আমার বেশ কিছু অভিজ্ঞতা হয়। আমরা একটা নতুন জায়গায় গল্প গুজব করতে পারি। গত কয়েক মাসে বন্ধুদের সঙ্গে অনেক কিছু করেছি।একবার একটা বইয়ের দোকানে ঘর ভাড়া নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটালাম। এছাড়া থ্যাঙ্কস গিভিং, ক্রিসমাস আর নিউইয়ারে বন্ধুদের ডেকে বেশ হুল্লোড় করলাম। লোকজনের সঙ্গে বেশ সময় কাটে। তবে লক্ষ্য করেছি মাস তিনেক ধরে আমার প্লেনে চড়তে ভয় লাগছে। এবার এই ভয়টা কাটানোর চেষ্টা করব। আমার অনেক অভিজ্ঞতা থাকলেও জিনিসপত্র খুব কমই আছে। আমি আমার বন্ধুদের সঙ্গে আমার জীবনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করি।

৫) আবিষ্কার

আমার নিজেকে হারিয়ে ফেলতে ভালো লাগে।পৃথিবীতে আজই আমার প্রথম দিন এটা ভাবতে আমি আনন্দ পাই। যখন আমি কোনও নতুন জায়গায় যাই। ওই জায়গাটাকে বোঝার চেষ্টা করি। আমি লোকজনের বইপত্র, আবর্জনা,তাদের গত তিরিশ বছরের ছবি উল্টেপাল্টে দেখি। তাদের না বলা গল্প পড়ার চেষ্টা করি।

বাইরে পা রাখলে,নতুন স্কাই লাইন দেখতে পাই। নতুন জায়গা দেখতে পাই। নতুন লোকজনকে ঘুরে বেড়াতে দেখি। ভাল ভাবে শ্বাস নিই। এক্কেবারে ছোটবেলার মত করে জায়গাগুলোকে বোঝার চেষ্টা করি। যেখানেই যাই জায়গাগুলোকে পুরো নতুন লাগে।

৬)আমার জীবনে সংখ্যা

প্রত্যেকের জীবনে কিছু সংখ্যা থাকে। রিটায়ার করতে কত টাকা লাগবে। বাঁচার জন্য কত টাকা প্রয়োজন সেই সংখ্যা। কত টাকা জমলে অফিসে বসকে ধমক দিয়ে চাকরি ছাড়া যাবে। সবকিছুরই একটা নির্দিষ্ট সংখ্যা আছে।

তবে আমার সংখ্যাটা আমি জানি না। তবে বাকি সকলের চাইতে আমার সংখ্যাটা কম হবে। কারণ আমার জীবনে চাহিদা নেই। নতুন জায়গা দেখা ছাড়া আমার জীবনে কোনও চাহিদা নেই।

আমার লাইফ স্টাইল আমি বদলাতে পারি। কোথাও থিতু হতে চাইলে তাও পারব।তবে আমি তা চাইনা। আমি কোনওদিন বাড়ি কিনব না। কোনও দিন আমার ছেলে মেয়েদের কলেজ পাঠাবো না। কারণটা আগেই বলেছি। আমার মনে হয়না আন্ত্রেপ্রেনিওরশিপ করতে আজকের দিনে কোনও খরচ লাগে।

আমি লিখতে পারি। আর যেকোনও জায়গায় থাকতে বা কাজ করতে ভালোবাসি।প্রত্যেকদিন আমি নতুন লোকজনের সঙ্গে মেলামেশার চেষ্টা করি যাতে নতুন কিছু জানতে পারি। আর কিছু না।

গত কয়েক মাসের খরচের কথা ভাবলে। খাবার আর নতুন অভিজ্ঞতা ছাড়া আর কিছুর পিছনে খরচ হয়নি। জিনিসপত্রের চাইতে সবসময় অভিজ্ঞতার দাম বেশী।লোকজন অভিজ্ঞতার দাম দিতে চায় না। তবে বাস্তব হল জীবনে একমাত্র অভিজ্ঞতারই দাম ফুরিয়ে যাবে। অভিজ্ঞতা হল একটা গল্প। আর আপনার জিনিসপত্র একদিন ভুলে যাওয়া স্মৃতি হয়ে যাবে। তাই আমি কম জিনিস কিনতে আর বেশী বেচতে আগ্রহী।

৭)শিঁকড়ের টান

আমার কোনও শিঁকড় নেই। একটা জায়গা নেই যেটাকে আমি আমার বাড়ি বলেতে পাড়ি। এটা ভাল না খারাপ তা বলতে পারব না। সেজন্য আমি নিজেকে পুরোপুরি পাল্টানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। একটা বাড়ি দেখে আমার পছন্দ হয়ে গেল। নতুন অভিজ্ঞতা হবে। সপ্তাহ খানেকেরও বেশী কোনও একটা জায়গায় থাকার ইচ্ছে হল।

বাড়ির মালিক একজন বিখ্যাত মিউজিসিয়ান। উনি তাঁর সঙ্গীত চর্চার জন্য ন্যাশভাইল যাচ্ছিলেন। ওর অ্যাপার্টমেন্টটা একদম সাজানো গুছনো। তিনটে পিয়ানোও আছে। আমাকে আবার নিজেকে এই কাগজ কলমের দুনিয়ায় ফিরিয়ে আনতে হল।

দুটো পার্সোনাল রেফারেন্সের দরকার ছিল। আমার পুরনো এক বাড়িওলারও রেফারেন্স লাগল। দুবছরের ট্যাক্স রিটার্নের কাগজ পত্র। দুটো ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট।আমার অ্যাকাউন্টট্যান্টের চিঠি। দুমাসের ভাড়া অ্যাডভ্যান্স দিলাম। আমার ক্রেডিট স্কোর কম ছিল। তাই আরও দুমাসের ভাড়া সিকিউরিটি ডিপোজিট রাখতে হল। আবার একটা চিঠিও লিখতে হল কেন আমার এই জায়গাটা ভাল লাগছে।আরেকটা চিঠি কোনওদিন কেন ক্রেডিট কার্ড ব্যাবহার করিনি তার জন্য। ওই অ্যাপার্টমেন্টে সবার সঙ্গে দেখা করতে হল (তবে তাঁরা সকলেই ভাল,আমার ভালই লাগল)।

এতকিছু করে বাড়ি ভাড়া নিয়ে রীতিমত ভয় পাচ্ছি। স্বপ্নেও আগামী একবছর আর বাড়ি ভাড়া করার চিন্তা করব না। নিজের একটা বাড়ি হোক। যার জন্য জিনিসপত্র কিনব।আর কিছু না হোক অন্তত বইপত্র,কাপড়চোপড়। যেখানে নিজেকে আইডেন্টিফাই করতে পারব। যাতে ওই এলাকা ছাড়তে আর না ইচ্ছা হয়।

আমি জানিনা কি করব। তবে যখনই কোনও জায়গায় শিঁকড় গেড়েছি , আমার গোটা জীবন পাল্টে গেছে। সত্যি বলতে কি, আমি এখন ভয় পাই। যখনই এক সপ্তাহের বেশী কোনও জায়গায় থেকেছি রীতিমত দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছি।

ছটফট করেছি। আপনিও কি আমার মতোই... তাহলে চলুন একদিন আড্ডা মারি। বেরিয়ে পড়ার প্ল্যান করি চলুন।

লেখক পরিচিত

লেখক জেমস অল্টচার একজন আমেরিকার হেজ ফান্ড ম্যানেজার,ব্যবসায়ী আর লেখক। তিনি ২০ টিরও বেশীর ফাউন্ডার বা কো-ফাউন্ডার।তার দাবী এদের মধ্যে ১৭ টাই সফল হয়নি।এখনও পর্যন্ত এগারোটা বই লিখেছেন।নিয়মিত ফিনান্সিয়াল টাইমস,হাফিংটন পোস্ট, দ্যা স্ট্রিট.কম,সিকিং অ্যালফা,থট ক্যাটালগ এনিয়মিত লেখেন।

অনুবাদ সুজয় দাস