দশ লক্ষ মানুষকে কাজ দিতে চান হনুমন্ত রাও

দশ লক্ষ মানুষকে কাজ দিতে চান হনুমন্ত রাও

Friday September 02, 2016,

8 min Read

ভারত বিকাশ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা হুনুমন্তরাও গায়কোয়াড় ২০২৭ এর মধ্যে ১০ লক্ষ লোককে কাজ দিতে চান। এখনও পর্যন্ত ৬৫ হাজার লোককে কাজ দিয়েছেন তিনি। ছোট বেলায় রেল স্টেশনে আম বিক্রি করতেন হনুমন্ত। কঠিন দারিদ্রের মধ্যে বড় হয়েছেন। ১০ ফুট বাই ১০ ফুটের একটা ছোট্ট ঘরে থাকত ওদের গোটা পরিবার। অসুস্থ বাবার চিকিৎসা করাতে মা নিজের মঙ্গলসূত্র বন্দক দিয়েছিলেন। বলছিলেন পয়সা বাঁচাতে হনুমন্ত রোজ ৪০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে যাতায়াত করতেন। কলেজের দিন থেকেই শুরু করেছেন ব্যবসা। প্ৰথমে রঙ করার কন্ট্রাক্ট নিতেন। সেই শুরু। পরিবারে কেউ কোনও কালে ব্যবসা বাণিজ্য করেননি। কিন্তু হনুমন্ত রাওয়ের বড় হওয়ার তাগিদ এবং দাঁড়াবার অদম্য ইচ্ছেটাই ওকে সাফল্য এনে দিয়েছে। আজ আমরা হনুমন্ত রাওয়ের কথা শুনব। স্বামী বিবেকানন্দ এবং শিবাজি মহারাজের অন্ধ ভক্ত হনুমন্ত নিজেকে ব্যবসায়ী কম এবং বেশি সমাজসেবী মনে করেন।

image


স্বামী বিবেকানন্দ যেমন চেয়েছিলেন তেমনি নিজেকে দেশ বদল করার জন্যে শত আত্মবিশ্বাসী যুবকের একজন মনে করেন হনুমন্ত। ১৯৯৭ সালে মাত্র ৮ জনকে সঙ্গে নিয়ে তৈরি করেছিলেন যে কোম্পানি আজ গোটা দেশে ২০টি রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। নানান শাখায় ভাগ হয়ে গেছে। তৈরি হয়েছে বিবিধ সংস্থা। এখনও পর্যন্ত ৬৫ হাজার মানুষের কর্ম সংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে তার গ্রুপ। এখন তাঁর ঝুলিতে ৭০০ ক্লায়েন্ট। সেই তালিকায় দেশ বিদেশের বিভিন্ন নামকরা সংস্থা। আপতকালীন চিকিৎসা থেকে শুরু করে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ভবনগুলির রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিষ্কার পরিচ্ছনতার কাজে নিযুক্ত রয়েছে এই সংস্থাই। যেসব ভবনগুলির কথা বলা হচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে, রাষ্ট্রপতি ভবন, সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রী বাসস্থল, দিল্লি হাইকোর্টের মত গুরুত্বপূর্ণ ভবন। দেশের একশরও বেশি রেল গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণও করে ভারত বিকাশ গ্রুপ। সংস্থার কর্ণধার হুনুমন্ত একটি একান্ত সাক্ষাৎকারে আমাদের জানিয়েছেন তিনি ২০২৭ এর মধ্যে ১০ লক্ষ লোককে কাজ দিতে চান ১০ কোটি মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়িয়ে দিতে চান। আর এই সব স্বপ্নকে মোটেই আজগুবি মনে হচ্ছে না কারণ হনুমন্তের ওপর ভরসা করা যায়। কারণ ওর জীবনটাই এমন যে ও এর আগেও এবং এখনও অবিশ্বাস্য কাজ অবলীলায় করে দেখিয়েছেন। শূন্য থেকে শুরু করে শীর্ষ পর্যন্ত পৌঁছেছেন তিনি।

হনুমন্ত রামদাস গায়কোয়াড়। মহারাষ্ট্রের সতারা জেলার কোড়েগাওয়ে জন্ম। বাপ ঠাকুরদার ভিটে রহিমতপুর গ্রামে। বাবা আদালতের কেরাণি ছিলেন। মা ঘরের কাজ করতেন। ছোটবেলা থেকেই হনুমন্ত লেখাপড়ায় ভালো ছিলেন। বাবা ওকে সতারায় নিয়ে আসেন সেখানে ভালো স্কুলে ভর্তি করান। ক্লাস ফোর থেকে বৃত্তি পাওয়া শুরু হয়। এই দশ টাকার বৃত্তির একটা প্রভাব পড়ে হনুমন্তের মনে। এক তো এটা বড়লোকের ছেলে মেয়ে পায় না। দুই সবাই এটা পায় না। শুধু মাত্র তারাই পায় যারা মেধাবী। ফলে এই থেকে একটা আত্মবিশ্বাস তৈরি হয় হনুমন্তের মনে। এটাই প্রথম সাহস দেয় হনুমন্তকে। কিন্তু দারিদ্রের বোধ ছোটবেলা থেকেই ছিল। ঘরে বিদ্যুত ছিল না। আর অন্য বন্ধুদের ঘরে ইলেক্ট্রিক আলো জ্বলত। এই সব নানান বৈষম্যের মধ্যে দিয়েই বড় হয়েছেন হনুমন্ত। ছোটবেলার কথা বলতে গিয়ে বলছিলেন, রহিমতপুর রেল স্টেশনে নিজেদের গাছের আম বিক্রি গল্প। তিন টাকায় ডজন দরে আম বেচতেন ছোটবেলায়। ট্রেন দাঁড়ালেই কাস্টমারের জন্যে প্লাটফর্মের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত দৌড়ে দৌড়ে আম বিক্রি করতেন। ঘরে কাঠ কুটোর উনুন ছিল। ফলে জ্বলানি সংগ্রহ করার গুরুদায় ছিল হনুমন্তের ওপরই। সবই হাসি মুখে করত হনুমন্ত। কিন্তু বৃত্তি পাওয়াটা ওকে পড়াশুনোকে আরও বেশি করে ভালোবাসতে শেখাল। বাবারও মনে হল আরও ভালো শিক্ষা দেওয়া দরকার। মনে হল পুনেতে গেলে আরও ভালো শিক্ষা পাবেন। তাই পুনে চলে এলেন সপরিবারে। পুনেতে হনুমন্তের মামা কিরলোস্কার কোম্পানিতে কাজ করতেন। তার সাহায্যেই পুনের কাছে ফুগেবাড়ি এলাকায় একটা ঘর ভাড়া নিলেন হনুমন্তের বাবা। এই ঘরটা সতারার ঘরের থেকেও ছোট ছিল। সেই ঘরেই চলে এল গোটা পরিবার। কোনও ক্রমে দিন চলছিল। কিন্তু সমস্যার পাহাড় ভেঙে পড়ল তখনই যখন হনুমন্তের বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেন।

দারিদ্রের কঠিন সময় তো আগেও দেখেছেন কিন্তু এবার জীবন মৃত্যুর মুখোমুখি এসে দাঁড়ালেন ওরা। মা নিজের মঙ্গলসূত্র বন্দক দিয়ে সেই টাকায় বাবার চিকিৎসা করাতেন। এক এক করে সব গয়না চলে গেল। অনেক টাকা সুদ গুণতে হত। টাকার জন্যে মা-ও কাজে নামলেন। সেলাইয়ের কাজ। হনুমন্তের মনে আছে যে মহিলারা মার কাছে কাজ নিতে আসতেন তাদের কাছে মা দু একটাকার জন্য কী ভীষণ কাকুতি মিনতি করতেন। কারণ হনুমন্তের স্কুলে যেতে যাতায়াতের বাসভাড়াই একটাকা লাগত। তখন হনুমন্ত পুনের মর্ডার্ন স্কুলে ক্লাস নাইনের ছাত্র। মা এবার স্থানীয় মিউনিসিপ্যাল স্কুলে চাকরি নিলেন। বাচ্চাদের পড়াতেন।

গোটা পরিবার তাকিয়ে ছিল হনুমন্তের দিকে। একদিন বড় হবে হনুমন্ত বড় আই এ এস অফিসার হবে। গোটা পরিবারের দুর্দশার অন্ত হবে সেদিন। একই স্বপ্ন দেখতেন তিনি নিজেও। মাথা পরিষ্কার ছিল। নম্বরও ভালো হত। ক্লাস টেনের পরীক্ষায় ৮৮ শতাংশ নম্বর পেয়েছেন। কিন্তু এবার কী করবেন এটা নিয়ে সংশয় ছিল। যে স্কুলে মা পড়াতেন সেই স্কুলের হেডমাস্টার মশাই অনেক ভেবেচিন্তে পলিটেকনিক কলেজে ভর্তি করার কথা বলেন। কারণ তারপর চাকরি পাওয়া সহজ। সেই অনুযায়ী পুনের সরকারি পলিটেকনিক কলেজে ইলেক্ট্রনিক্স নিয়ে ভর্তি হন হনুমন্ত। সেকেন্ড ইয়ারে যখন পড়েন বাবা মারা যান। বাবার স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার জন্যে পলিটেকনিকের পর বিটেক পড়তে চান। দূরে পড়তে যেতে মা বাড়ন করেন। কিন্তু স্থানীয় কলেজে ভর্তি হতে লাখ টাকা চাওয়া হয় অ্যাডমিশনে। ফলে একটু দূরে পুনের সরকারি কলেজে বিটেকে ভর্তি হয়। বাড়ি থেকে কুড়ি একুশ কিলোমিটার দূরের কলেজ। যাতায়াতের খরচ বাঁচাতে সাইকেলে রোজ যাতায়াত করতেন তিনি।

এই সময় মাকে সাহায্য করতে পড়াশুনোর পাশাপাশি কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্রদের পড়াতেন। সেই টাকা দিয়ে নিজের পড়াশুনোর খরচ এবং সংসার চালানোর খরচ জোগাড় করার চেষ্টা করতেন। বন্ধু যোগেশ আত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে জ্যাম সসও বিক্রি করা শুরু করেন। পাশাপাশি বাড়ি ঘর রঙ করার ব্যবসা শুরু করেন। বাবার মৃত্যুর পর বাবার গ্র্যাচুইটির যে টাকা পয়সা পাওয়া গিয়েছিল তা দিয়ে মা একটা ছোট্ট জমি কেনেন। এবং দুটো ঘরের একটা বাড়ি বানান। বাড়ি রঙ করতে গ্রাম থেকে মিস্ত্রিদের আনা হয়। ওই কাজ চলার সময় রঙ করাটা খুটিয়ে খুটিয়ে শিখে ফেলেন হনুমন্ত। জেনে ফেলেন কত লাভ এই রঙের কাজে। ব্যবসা করার ভূত চেপে বসে কাঁধে। তারপর রঙের কাজ জানা কর্মীদের গ্রাম থেকে আনান হনুমন্ত। লোকের বাড়ি রঙ করার ঠিকা নিতে থাকেন। বাড়তে থাকে ব্যবসা। সেই শুরু। শুধু রঙ করার কাজ নয় এক এক করে অন্যান্য ক্ষেত্রেও ব্যবসা করার সুযোগ খুঁজতে থাকেন তিনি। সেই সময় খবর পান বালেবাড়ি স্টেডিয়ামকে সাজানোর কাজ হবে। সেই কাজ পাওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগেন। কাজটা পান এবং তারপর সরকারের ঘর থেকে টাকা তুলে আনার মত কঠিন লড়াইটাও দারুণ লড়েন। লড়ালড়ির চক্করে, বিটেকের ফাইনাল ইয়ারের বেশ কয়েকটি পরীক্ষাও দিতে পারেননি। কিন্তু বাকি পেপারগুলোয় ভালো ফল করায় শেষ মেশ পাস করে যান।

কখনও হারতে শেখেননি হনুমন্ত। বাবা শিবাজির কথা বলতেন সেই সব গল্পগুলো ওর রক্তে তেজ সঞ্চার করত। স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ওঁকে দুর্দমনীয় হওয়ার হিম্মত দিত। সেই থেকে অন্য কিছু করার কথা ভেবেছেন। সমাজ সেবার আগ্রহ থেকে শুরু করেছিলেন ভারত বিকাশ প্রতিষ্ঠান।

ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করার পরই টাটা মোটরস বা টেল্কোয় কাজ পেয়ে যান হনুমন্ত। এই সময় কোম্পানির জন্যে মন দিয়ে কাজ করেন। আবর্জনায় পড়ে থাকা কেবল পুনর্ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়ে কোম্পানির আড়াই কোটি টাকার লোকসান বাঁচিয়ে দেন। ফলে ভাইস প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে প্রশংসা পান। ভিপি জানতে চান, হনুমন্তকে কীভাবে সাহায্য করতে পারেন তিনি। হনুমন্ত চেয়ে বসেন তাঁর গ্রামের বেকার যুবকদের জন্যে হেল্পারের চাকরি। কিন্তু সেটা এমনি হওয়ার ছিল না। এটার জন্যে কোনও সংস্থার মারফত এই ধরণের কাজ করাতে চায় টাটা কর্তৃপক্ষ। তখনই মগজের আলো জ্বলে ওঠে। তাঁর নিজের সংস্থা ভারত বিকাশ প্রতিষ্ঠানের হয়ে বন্ধু উমেশ মানের তরফ থেকে আবেদন জমা করেন। এবং সেই সময় ইন্ডিকার প্ল্যান্ট তৈরি হচ্ছিল। সেই প্লান্টের দেখভাল করার সুযোগও পেয়ে যায় হনুমন্তের সংস্থা। ১৯৯৭ সালে সেই কন্ট্রাক্ট পায়। প্রথম বছর ৮ লাখ টাকার আমদানি হয় দ্বিতীয় বছর ৩০ লাখ টাকার এবং তার পরের বছর ৬০ লাখ টাকার আমদানি হয়। ১৯৯৯ সালে বিয়ে করেন। এবং সিদ্ধান্ত নেন চাকরি ছেড়ে পুরোদমে ব্যবসাই করবেন। কিন্তু মা বেঁকে বসেন। ভালো আর পাকা চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কথা শুনে মা রেগে যান। দীর্ঘ দিন লড়াই করে সবে সুখের মুখ দেখেছেন। পরিবারে চোদ্দ গুষ্ঠিতে কেউ কোনওদিন ব্যবসা করেনি। সবে বিয়ে করেছেন এরকম অবস্থায় ব্যবসা করা মানে নিজের পায়ে কুড়ুল মারা। অন্তত তাইই মনে হয়েছিল মার। অনেক কষ্টে মাকে রাজি করিয়েছিলেন হনুমন্ত। বলেছিলেন এমন কোনও কাজ তিনি করবেন না যা তাকে দিয়ে অন্যায় কিছু করাতে পারে মিথ্যে বলাতে পারে। বাবার সম্মান নষ্ট হয়। এত সব বলার পর মা রাজি হন।

এর পর থেকে শুধু ব্যবসাতেই মন দেন হনুমন্ত। ভারত বিকাশ প্রতিষ্ঠানের নাম বদলে করলেন ভারত বিকাশ সার্ভিসেস। শুরু হল বিভিন্ন ধরণের পরিষেবা দেওয়ার কাজ। ব্লু কলার জব। শুধু পুনেতেই আটকে থাকল না তার সংস্থা ছড়িয়ে গেল একের পর এক শহরে। খোদ রাজধানিতেও ছড়িয়ে পড়ল সংস্থার কাজ। ২০০৪ সালে ভারত বিকাশ সার্বিসেজ কে দেওয়া হল সংসদ ভবনকে যন্ত্রের মারফত পরিষ্কার করার কাজ। এটাই ছিল ব্রেক থ্রু। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। নানান কাজের জন্যে এক এক করে নানান সংস্থা মাথা তুলেছে এক এক করে। সব সংস্থাকে এক সূত্রে বেঁধে তৈরি হয় ভারত বিকাশ গ্রুপ। এই গ্রুপের তত্বাবধানে চলে আসে দেশের একশটিরও বেশি রেল গাড়ি, প্রায় সব এয়ারপোর্ট, রেলস্টেশন, সরকারি ভবন, কর্পোরেট হাউস। শুধু দেশে নয় বিদেশেও বিভিন্ন সংস্থায় এই ব্লু কলার সার্ভিস দেয় এই সংস্থা। ৬৫ হাজার লোক কাজ করে এই গ্রুপে।

ভবিষ্যতে আরও বিস্তৃত হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন হনুমন্ত। বলছেন লোকে কাঁচ এবং হীরার মধ্যে পার্থক্য করতে জানেন না। কেবল জহুরি সেটা চেনেন। আর আপনি যে কাঁচ নন হীরা সেটা আপনাকেই প্রমাণ করতে হবে। নিজেই নিজেকে ডেডলাইন দিয়েছেন। ২০২৭ এর মধ্যে এই ৬৫ হাজারের সংসার বাড়িয়ে ১০ লক্ষে পৌঁছে দেবেন তিনি। হাসি ফুটবে ১০ লক্ষ পরিবারে। আর সেটা যে খুব অসম্ভব নয় শিবাজি মহারাজে ভক্ত বিশ্বাস করেন।