বধিরান্ধদের কথা কেউ কি ভাবে? প্রশ্ন রুমাদেবীর

বধিরান্ধদের কথা কেউ কি ভাবে? প্রশ্ন রুমাদেবীর

Sunday March 06, 2016,

4 min Read

প্রতিদিন আমি আপনি এরকম অনেক মানুষের সঙ্গে ধাক্কা খাই। হাতে লাঠি নিয়ে রাস্তা পেরোতে না পারলে আমি আপনি এগিয়ে আসি। হাত ধরি। জেব্রা ক্রসিং পার করে দিই। কিন্তু ওঁদের নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবার অবকাশ আমার আপনার খুব একটা হয় না। আজ আলাপ করব এমন এক লড়াকু মহিলার সঙ্গে যিনি দীর্ঘদিন অন্ধ ও বধির মানুষের সহায়। ইতিহাসের অধ্যাপনা ছেড়ে দিনরাত এক করে লড়ছেন বধিরান্ধদের জন্যে। তিনি রুমা চট্টোপাধ্যায়। তাঁর সংস্থা SVH বা Society for the Visually Handicapped। শুনব সেই সংস্থার জন্ম বৃত্তান্তও।

image


ইয়োর স্টোরি - কবে থেকে বধিরান্ধদের নিয়ে আপনাদের কাজের ভাবনা?

রুমা – প্রথমেই জানিয়ে রাখা ভালো, এদেশে বধিরান্ধরা সরকারিভাবে আজও সম্পূর্ণ অবহেলিত। মাল্টিপল ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত এইসব ছেলেমেয়েরা সরকারি কোনও প্রকল্পের সুযোগই পায় না। এমনকি, এ ধরনের ডিসঅর্ডারের ছেলেমেয়েদের জন্য সরকারি স্তরে ডাক্তারবাবুরা মাল্টিপল ডিসঅর্ডার উল্লেখ করে মেডিক্যাল সার্টিফিকেটও ইস্যু করেন না। বরং, ডাক্তারবাবুরা একজন বধিরান্ধকে কেবলমাত্র দৃষ্টিহীন লিখে দিয়েই কাজ সারেন। শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্যি। তাতেও ভারতে নথিভূক্ত বধিরান্ধের সংখ্যা অন্ততপক্ষে পাঁচ লক্ষ।

ইয়োর স্টোরি – আপনি তো ইতিহাসের অধ্যাপিকা। মূলত লেখাপড়ার জগতের মানুষ। কীভাবে স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত হলেন?

রুমা – কলেজে ইতিহাস পড়ানোর চাকরি থেকে এখন অবসর নিয়েছি। ফলে পুরো সময়টাই এখন সংগঠনকে দিতে পারি। আসলে আমার বরাবরের ইচ্ছে ছিল, সমাজের জন্য নিজে কিছু কাজ করব। সেইসূত্রেই নব্বুই দশকের প্রথম দিকে যুক্ত হই এসভিএইচ-এর সঙ্গে। এই প্রতিষ্ঠান তখন প্রধানত দৃষ্টিহীনদের নিয়ে কাজ করত। কাজ বলতে মূলত প্রশিক্ষণ। ব্রেল পদ্ধতিতে ওঁদের লেখাপড়া শিখতে কী ধরনের সমস্যা হচ্ছে, তা জেনে নিয়ে দৃষ্টিহীন পড়ুয়াদের যথাসাধ্য সহায়তা করা হত। এখনও সে কাজ আমরা করে থাকি। 

আশির দশকের গোড়ার দিকে আমাদের সংস্থা গড়়া হয়েছে। যে মানুষটি প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন, তাঁর নাম শ্যামল দত্ত। ৯০ দশকের প্রথমদিকে সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর প্রতি মঙ্গলবার পরিচালন কমিটির সদস্যরা মহারাষ্ট্র ভবনে মিলিত হতাম। আজও হই। সেখানে দৃষ্টিহীন ছেলেমেয়েদের নিয়ে তাঁদের অভিভাবকেরা আসেন। ওঁদের অসুবিধাগুলি সম্পর্কে জানান। বিশেষত, ব্রেল পদ্ধতিতে লেখাপড়া চালাতে গিয়ে ছেলেমেয়েরা কী ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে, সে ব্যাপারে শুনে গোড়া থেকেই আমরা সমাধানের চেষ্টা করি। এজন্য আমি নিজেও ব্রেল শিখেছি আমাদের সংস্থার সচিব হেনা বসুর কাছে। ব্রেল পদ্ধতিতে পঠনপাঠনকে কীভাবে আরও উন্নত করা যায়, এও আমাদের কাজের অন্যতম বিষয়।

ইয়োর স্টোরি – এছাড়া, আপনারা বর্তমানে আর কী কী ধরনের কাজ করছেন?

রুমা – প্রতিবন্ধীদের সহায়তা করার জন্যে বছরভর নানা প্রোগ্রাম নেওয়া হয়। তার ভিতর রয়েছে স্বাস্থ্য সচেতনতা সম্পর্কিত কর্মশালা, প্রতিবন্ধীদের প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত ও উন্নয়নমূলক নানা সেমিনারের আয়োজন, বধিরান্ধদের জন্য আমাদের ভোকেশনাল প্রজেক্ট আছে। একটা কথা, ২০০৫ সালে মাত্র পাঁচজন বধিরান্ধকে বেছে নিয়ে আমরা কাজে নেমেছিলাম। তখন ওই শিশুদের বয়স ছিল ১০-১১ বছর। পরে ওই ছেলেমেয়েরাই কিছুটা পরিণত হওয়ার পরে বৃত্তিশিক্ষা প্রকল্পে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এখন সংস্থাও বড় হয়েছে। বিনা পারিশ্রমিকে প্রায় ৮৩জন স্বেচ্ছাসেবী আমাদের হয়ে কাজ করছেন। প্রতিবন্ধী শিশু-কিশোরদের সহায়তা করার জন্য আমাদের নিজস্ব ৯জন শিক্ষক-শিক্ষিকা রয়েছেন। তাঁরাও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। প্রয়োজন মতো প্রতিবন্ধী শিশু ও কিশোরদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রশিক্ষণ দেন ওঁরা। এজন্য সংস্থা থেকে কিছু টাকা বেতন পান।

ইয়োর স্টোরি – পরিচালন কমিটিতে কারা রয়েছেন?

রুমা – পরিচালন কমিটিতে সমাজের নানা স্তরের প্রতিষ্ঠিত এবং মানী মানুষজন আছেন। শিক্ষক-শিক্ষিকা, ডাক্তারবাবু থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ সরকারি চাকুরে-সহ বিভিন্ন পেশার মানুষ রয়েছেন। ওঁরা সকলেই প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়ে তথা সমাজের জন্য ভালো কিছু কাজ করার সদিচ্ছা নিয়ে আমাদের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত।

ইয়োর স্টোরি – বধিরান্ধ কি জন্মগত প্রতিবন্ধকতা?

রুমা – দুভাবে বধিরান্ধ হন একজন মানুষ। কেউ কেউ জন্মগতভাবেও ‌এই সমস্যায় ভোগেন। আবার অনেকক্ষেত্রে আঘাত পেয়ে বা গুরুতর কোনও অসুখের জেরে মানুষ চোখে দেখা ও কানে শোনার ক্ষমতা হারিয়ে মানুষ বধিরান্ধ হয়ে পড়েন। সমস্যার গুরুত্ব অনুযায়ী এদেরকে বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করা হয়ে থাকে। ২০০৫ সাল থেকে আমরা এসভিএইচ প্রজেক্ট ডেফব্লাইন্ড শুরু করেছি।

ইয়োর স্টোরি – একাজে কি সমমনস্ক কোনও সংস্থার সহায়তা পান?

রুমা – হ্যাঁ, সম্প্রতি আমরা সেনস ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছি। সেনস একটি সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান। আমরা গত অক্টোবর থেকে সেনস ইন্টারন্যাশনালের স্টেট লার্নিং সেন্টার হিসাবে বহিরান্ধদের জন্যে কাজ শুরু করেছি। এছাড়া, আমরা কাজ করছি মানসিকভাবে অনগ্রসরদের ওপরও। নানান বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ওঁদের স্বনির্ভর করে তোলাটাও আমাদের অন্যতম উদ্দেশ্য।

ইয়োর স্টোরি – একজন মহিলা হিসাবে প্রতিষ্ঠানের কাজের গুরুদায়িত্ব সামলানোর উপলব্ধি কেমন?

রুমা –একজন নারী হিসাবেই তরুণ বয়সে সমাজের জন্য উপকারী কিছু কাজ করার স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্নের কিছু কিছু বাস্তবায়িত হয়েছে। সামান্য হলেও তাতে আমার ভূমিকা তো আছেই। একজন নারী হিসাবে এটা আমার জীবনে এক ধরনের সার্থকতা।