মাত্র পাঁচহাজার টাকা নিয়ে ৩৫ বছর আগে ব্যবসায় নেমেছিলেন নন্দকিশোর চৌধুরি। দু’টি তাঁত বোনার মেশিন, একটি বাইসাইকেল, কিছু উল নিয়ে কার্পেটের ব্যবসা শুরু করেন। নয় জন তাঁতিকেও রাজি করিয়ে ফেলেন। সেই শুরু। ১৯৯০ সালে গুজরাতের একটি গ্রামে স্ত্রী এবং পাঁচ সন্তানকে নিয়ে চলে আসেন নন্দকিশোর। আর আজ ২৫ বছর পর তাঁর বড় মেয়ে আশা আমেরিকায় লেনদেন দেখেন, অর্চনা বোনা জিনিসের মান নির্ধারণ করেন, ছোট মেয়ে কবিতা ডিজাইন বিভাগের প্রধান। ছেলে যোগেশ অফিসের বাকি কাজ সামলান।
নন্দকিশোরের ব্যবসার উন্নতির মূল চাবিকাঠি একটাই, তাঁতিদের অর্থাৎ তাঁর কর্মচারীদের খুশি করা। ১১টি রাজ্যে বর্তমানে ব্যবসা রমরমিয়ে চলছে জয়পুর ব়্যাগস ফাউন্ডেশনের (জেআরএফ)। এরা আবার জয়পুর ব়্যাগস গ্রুপের একটি অংশ, যাঁরা ভারতের বৃহত্তম কার্পেট ব্যবসায়ী।
নন্দকিশোর তাঁর কোম্পানিতে সুযোগ দেওয়ার চেষ্টা করেন দরিদ্র তাঁতিদের। শুধু তাই নয়, যাঁরা কাজ জানেন না, তাঁদের প্রশিক্ষিত করে কাজের সুযোগ দেওয়া হয়। জেআরএফ-এ বর্তমান তাঁতির সংখ্যা ৪০ হাজার। ১১টি রাজ্যের ১০২টি গ্রাম, ৭টি ব্লক এবং ৫টি জেলার কাজ করছেন জেআরএফ।
জেআরএফ-এর কার্পেটের বিশ্ববাজারে খ্যাতির শীর্ষে। প্রত্যেক তাঁতির এখানে অধিকার রয়েছে নিজের ডিজাইনের অপর কাজ করার। যার ফলে এক একজনের ডিজাইন হয়ে ওঠে অনন্য। প্রত্যেকের শ্রম এবং চিন্তাভাবনার মূল্য এখানে যথাযথ ভাবে দেওয়া হয় বলে জানালেন নন্দকিশোর। জেআরএফ-এর কাজকর্মকে দু’টি ভাগে ভাগ করা যায়। এক, দ্য এন্টারপ্রাইস ডেভেলপমেন্ট, যারা তাঁতিদের প্রতিভা এবং স্বচ্ছ্বল জীবনযাপনের ওপর নজর রাখে। দুই, সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট, যারা পরবর্তী প্রজন্মকে এই কাজ সম্পর্কে সচেতন করে। এছাড়াও তাঁতিদের জন্য স্বাস্থ্যশিবির, স্বাস্থ্যপরীক্ষা এবং স্বাস্থ্যবিমার ব্যবস্থা করা হয়। তাঁদের প্রতিভার আরও উন্নতি কী করে করা যায়, তা নিয়ে তাঁতিদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়। নন্দকিশোর জানিয়েছেন, ‘অনেক তাঁতি ছিলেন, যাঁদের নিজেদের জন্য একটা জামা কেনারও সামর্থ্য ছিল না। বাচ্চাদের দূরে পাঠানো তো দূরস্থান, কিন্তু তাঁদের আমি বিশ্বাস দিয়েছিলাম, আমার সঙ্গে থাকলে তাঁরা জীবনটা সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে পারবে। আজ প্রত্যেক তাঁতির ছেলেমেয়েরা স্কুলে যায়। আমি চেষ্টা করি, যে কটা গ্রামের সঙ্গে আমাদের কাজ চলছে, সেই সব গ্রামে অন্তত একবার করে যাওয়ার। সেখানে গেলে তাঁদের মুখে আমি হাসি দেখতে পাই।’
৭০’-এর দশকে নন্দকিশোর কাজ শুরুর সময় বেশ কিছুদিন উপজাতি সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিশেছিলেন। তখন এই সম্প্রদায়ের মানুষরা ছিলেন অচ্ছুত। সামাজিক নিয়মই ছিল, এঁদের সঙ্গে যাঁরা মিশবেন, তাঁদের সমাজ থেকে বহিস্কৃত করা হবে। কিন্তু এসবের তোয়াক্কা করেননি নন্দকিশোর। কারণ, এই সব সম্প্রদায়ের মধ্যেই লুকিয়েছিল আসল প্রতিভা। দিনের পর দিন তাঁদের সঙ্গে মিশেছেন, একসঙ্গে বসে খেয়েছেন। পরিবর্তে নিজের সমাজের কাছ থেকে কুড়িয়েছেন ধিক্কার। কিন্তু তার সঙ্গেই পরিবারের কাছ থেকে পেয়েছেন অকুণ্ঠ সমর্থন। নন্দকিশোর আজও বুঝতে পারেন না, মানুষের বিচার প্রতিভা দিয়ে না করে জন্ম দিয়ে কেন করা হয়?
জয়পুর ব়্যাগস ফাউন্ডেশনের জন্ম ২০০৪ সালে। যদিও তার অনেক আগেই নন্দকিশোর এবং তাঁতিদের শ্রম জয়পুর কার্পেট নামে মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছে। বর্তমানে অনেকেই বুঝতে পেরেছেন নন্দকিশোরের লক্ষ্য। নিজের ব্যবসা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তিনি যে সামাজিক উন্নয়ন করেছেন, তাতে সমর্থন জানিয়েছেন অনেক বিদেশি কোম্পানিও। ফলে সেখান থেকে বিনিয়োগের মাত্রা কম নয়। নন্দকিশোরের বিশ্বাস, কোনও লক্ষ্যপূরণের ক্ষেত্রে দরকার সততা, স্বচ্ছতা, কাজের প্রতি আত্মনিবিষ্ট হওয়ার ক্ষমতা।
Related Stories
Stories by Chandra Sekhar
March 14, 2017
March 14, 2017
March 14, 2017
March 14, 2017