সাইকেলে একপাল দেবদূত, কুড়োচ্ছে কুর্নিশ

সাইকেলে একপাল দেবদূত, কুড়োচ্ছে  কুর্নিশ

Saturday September 12, 2015,

4 min Read

বৃষ্টির জলে চাষবাস আর সাইক্লিং। এই দুটির মধ্যে মিল কোথায়? ধাঁধা মনে হলেও উত্তরটা কিন্তু সহজ। উত্তর মিলবে মহারাষ্ট্রে। পুনে থেকে ৭৫ কিলোমিটার দূরের একটি ছোট্ট ভূখণ্ড মান্ধার দেবী। সেই গ্রামের মানুষ চাষবাসের জন্য একসময় আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতেন। একদিন প্রতীক্ষার শেষও হতো। কিন্তু প্রকৃতির কৃপণতায় চাহিদা মিটত না। পর্যাপ্ত জলের অভাবে শুকিয়ে যেত ফসল। দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা এই সমস্যার মোকাবিলায় এগিয়ে আসে সেবাবর্ধিনী (একটি এনজিও)।বৃষ্টির জল ধরে রেখে চাষবাস। সেটাই ছিল সমাধান। কিন্তু এই সমাধান শুনতে যতটা সহজ, আর্থিক কারণে ততটা সহজ হল না। পুরো প্রকল্পের খরচ ধরা হল ৭ লক্ষ টাকা। কিন্তু অনেক চেষ্টার পরেও ডোনেশন উঠল সাড়ে পাঁচ লক্ষ টাকা। ঘাটতি প্রায় দেড় লক্ষ টাকা।সেই আর্থিক ঘাটতি মেটাতে এগিয়ে আসে আর্ন ব্লেসিংস (Earn Blessings) নামে একটি সংস্থা।ব্যবস্থা হয় বাকি টাকার বেশিরভাগের। সৌজন্যে সাইক্লিং।

পুনের সারতাজ থেকে মান্ধার দেবী। ১৫৪ কিলোমিটার এই পথ সাইকেল যাত্রায় বের হন আর্ন ব্লেসিংসের ১১ জন রাইডার। চলতে থাকে ডোনেশন সংগ্রহের কাজ। কৃষকদের পাশে দাঁড়াতে কয়েকজন যুবকের এমন কষ্টসাধ্য উদ্যোগে অভিভূত হন গ্রামবাসীরাও। সাধ্যের মধ্যে যে যতটুকু পারেন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। দেখা যায় জমা পড়েছে এক লক্ষ দশ হাজার টাকা।সেই টাকা তুলে দেওয়া হয় সেবাবর্ধিনী সংস্থায়। আসলে আর্ন ব্লেসিংসের কাছে এটা নতুন কিছু নয়। এনজিও'গুলির ডাকে সাড়া দিয়ে বিভিন্ন কারণে এভাবেই পথে নামেন সংস্থার সদস্যরা। ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে এভাবেই সাতবার সাইকেল যাত্রায় উঠে এসেছে প্রায় চার লক্ষ টাকা। শিশু শিক্ষা, এইচআইভি আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা, জলসেচ ব্যবস্থা, লো ইনকাম গ্রুপের পরিবারের ছেলেমেয়েদের জন্য হস্টেল- এমন বিভিন্ন কারণে বারবার পথে নেমেছে আর্ন ব্লেসিংস।

রাইডারদের সঙ্গে সোহম (একদম বাঁদিকে)

রাইডারদের সঙ্গে সোহম (একদম বাঁদিকে)


আর্ন ব্লেসিংসের পুরো কর্মকাণ্ড শুধু সাইক্লিংয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ এমনটা কিন্তু নয়। সংস্থার অন্যতম প্রধান মুখ সোহমের সঙ্গে কথায় জানা গেল বিভিন্ন এনজিও'কে রিপোর্ট তৈরি, সিএসআর প্রস্তাব, ব্র্যান্ডিং ইত্যাদি ব্যাপারে সহায়তা করে থাকেন তাঁরা। সোহম বললেন, 'মানুষ যাতে একটু ভালোভাবে থাকতে পারে এবং সেকাজে আমরা সামান্য সহায়তাও করতে পারি, সেটাই আমাদের প্রাপ্তি। প্রত্যেক রাইডের পরে আমরা যে আনন্দ পাই সেটাই আমাদের আশীর্বাদ। আর সেটাই এই আর্ন ব্লেসিংস'। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষ নিয়ে সাইক্লিং টিম গড়ে তোলা হয়। সদস্যদের মধ্যে মূলত দুটো জিনিস দেখা হয়। সাইক্লিংয়ে উৎসাহ আর সমাজকে কিছু ফিরিয়ে দেওয়ার মানসিকতা। সোহমের কথায়,'এই সাইক্লিং এখন আমাদের সদস্যদের জীবনের অংশ হয়ে গিয়েছে। একটা যাত্রার পরেই তারা তাকিয়ে থাকেন পরবর্তী সাইক্লিংয়ের জন্য'।

সাইক্লিংয়ের যাত্রাপথ কমবেশি ১২০ থেকে ১৫০ কিলোমিটারের মধ্যে রাখা হয়। সাধারণত সপ্তাহের শেষের দিকে এইসব রাইডিং হয়। একজন রাইডার নিজেই ঠিক করে নেন তিনি কতটা রাইডিং করতে চান। সেক্ষেত্রে তাদের ওপর কোনও টার্গেট চাপিয়ে দেওয়া হয় না। কারণ এটাও বুঝতে হয়, এই কাজ থেকে সাইক্লিস্টরা কোনও টাকা পান না। কাজটা তারা ভালোবেসেই করেন।

কীভাবে কাজ করে আর্ন ব্লেসিংস? প্রথমে ঠিক করা হয় কোন সামাজিক ক্ষেত্রে অবদান রাখা হবে, কেন রাখা হবে। একবার সেটা ঠিক হলে খোঁজ নেওয়া হয় সেইসব এনজিও সম্পর্কে যারা একই বিষয়ে কাজ করছে। এবার দুয়ে মিলে আরও বিস্তৃত আলোচনা। ডোনেশনের মাধ্যমে কতটা ফান্ড প্রয়োজন তা ঠিক করে কাজে নেমে পড়া। সোহম বলেন,' ডোনেশন সংগ্রহ করতে আমরা যাত্রাপথকে আর্থিক অঙ্গীকারের সঙ্গে মিশিয়ে দিই। ধরুন আমরা ১০০ কিলোমিটার রাইডিংয়ের জন্য বেছেছি। প্রতি কিলোমিটারের জন্য ডোনেশন রাখা হয়েছে ৫ টাকা। এখন কেউ একজন আমাদের এই কাজে সাহায্যের হাত বাড়াতে চান। সেক্ষেত্রে তিনি ৫ টাকা হিসাবে ১০০কিলোমিটারের জন্য ৫০০ টাকা দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ হলেন।আবার রাইডারের সংখ্যা অনুযায়ী কেউ-কেউ ডোনেশন দিয়ে থাকেন। সেক্ষেত্রে রাইডারের সংখ্যা যত বেশি হয়, ডোনেশনও তত বেশি জমা পড়ে।

image


আর্থিক স্বচ্ছতার প্রশ্নে এতটুকুও আপোস করে না আর্ন ব্লেসিংস। সাইক্লিস্টরা রাইডিংয়ের জন্য কোনও টাকা নেন না। ফলে তাদের কাছে কোনও কিছুই গোপন রাখা হয় না। কত টাকা উঠল, সেই টাকা কোথায় দেওয়া হল সবই ওয়েবসাইটে অডিটেড রিপোর্টের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়। এটা একটা দিক।

আর্ন ব্লেসিংসের রেভিনিউ মডেলটা কেমন? এক্ষেত্রে আর্ন ব্লেসিংসের নীতিই হল জিরো ব্যাঙ্ক ব্যালান্স মডেল। অর্থাৎ যত টাকা উঠবে তত টাকাই বিলিয়ে দিতে হবে। একটু সংযোজন করে সোহম বলেন,'ডোনারদের থেকে আমরা যে টাকা পাই তার সবটুকুই এনজিওদের হাতে তুলে দেওয়া হয়।এমনকী এই যে আমরা সাইক্লিং করি, সদস্যদের

খাওয়াদাওয়া সে সবও আমরা নিজেদের পকেট থেকে দিই। তবে কী জানেন আমার একটাই আক্ষেপ। আমাদের তরুণরা সাইক্লিংয়ের জন্য সেভাবে এগিয়ে আসছেন না'। এভাবেই এগিয়ে চলেছে আর্ন ব্লেসিংস।স্ব্প্ন আরও পথ চলার, আরও বেশি সংখ্যক মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর। স্বপ্ন আরও রয়েছে। দেশের যত এনজিও রয়েছে সবার জন্যই কাজ করতে চায় আর্ন ব্লেসিংস। আর যাদের আর্থিক ক্ষমতা বেশি তাদেরকে একটা ছাতার তলায় আনতে, যাতে তারাও সমাজকে কিছুটা ফিরিয়ে দিতে পারেন।