পথ বন্ধুর হলেও সঙ্কল্পে স্থির জিনা খুমুজাম
Sunday October 04, 2015,
4 min Read
সকাল থেকেই বারবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করছিলাম। তবে মণিপুরের খারাপ আবহাওয়া বাধ সাধছিল। অবশেষে নেটওয়ার্ক পাওয়া গেল। ফোনের ওপারে চৌষট্টি বছরের মহিলা উদ্যোগপতি জিনা খুমুজাম। স্থানীয় মানুষ তাঁকে 'Herbal Healer'নামেই ডাকতে পছন্দ করেন। জিনার সংস্থা 'মঙ্গল' আট ধরণের ভেষজ সাবান উৎপাদন করে থাকে। ২০০৪ সাল থেকে শুরু করে গত এগারো বছরে ভেষজ এই সাবানের জনপ্রিয়তা বেড়েই চলেছে। তবে প্রথমে জিনা খুমুজামের কোম্পানির নাম ছিল 'আওয়ার রেস্ট হাউস'। ২০১১ সালে তিনি নাম বদলে রাখেন 'মঙ্গল'। 'আমি নয়াদিল্লিতে রাষ্ট্রপতির এক প্রদর্শনীতে অংশ নিতে গিয়েছিলাম। সেই সময়ই সংস্থার নাম বদলের সিদ্ধান্ত নিই,' জানালেন মৃদুভাষী জিনা।
চার সন্তানের মা জিনা খুমুজাম জীবনের সব অভিজ্ঞতাই সঞ্চয় করেছেন কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে। তাঁর বৈবাহিক জীবনে সুখ ছিল ক্ষণস্থায়ী। মদাসক্ত স্বামী সংসারের প্রতি মনযোগী ছিলেন না। চার সন্তানের মুখে দু'বেলা দু'মুঠো খাবার তুলে দিতেই নাভিশ্বাস উঠতো জিনার। তাই ছেলেমেয়েদের পড়াবেন এমন চিন্তা তাঁর কাছে ছিল বিলাসিতার সমান। স্বামীর সঙ্গে নিত্যদিনের অশান্তি লেগেই থাকতো। জিনা উপলব্ধি করেছিলেন, নিজে থেকে কিছু করে উঠতে না পারলে পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্ভব নয়। পরিবারের হাল ধরতেই নিজের ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নেন জিনা খুমুজাম। পাহাড়ের আর পাঁচজন মহিলার মতো তাঁরও উল বোনার কাজ জানা ছিল। নিজে হাতে উলের ব্লাউজ, মোজা, গ্লাভস বুনে বিক্রি করতে শুরু করলেন। খালি সিমেন্টের বস্তা সংগ্রহ করে তাতে নানারকম সেলাইয়ের কাজ করে ব্যাগ বানিয়ে বিক্রি করতে লাগলেন। কষ্ট করে এভাবেই কাজ করছিলেন। হঠাৎ আসা একটি সুযোগ জিনার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। সাবান বানানোর প্রশিক্ষণ নিলেন জিনা খুমুজাম। প্রশিক্ষণ শেষে বাড়িতে বসেই সাবান তৈরি করতে শুরু করলেন। প্রথমদিকে শশা, লেবুর মতো জিনিস ব্যবহার করেই সাবান প্রস্তুত করতেন। ধীরে ধীরে অ্যালো ভেরা, নিম, হলুদের মতো উপাদানকেও কাজে লাগাতে শুরু করলেন। ছোটবেলায় দাদু-দিদিমার কাছে বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদানের গুণাগুণ জানতে পেরেছিলেন জিনা। সেই জ্ঞান থেকেই প্রাকৃতিক উপাদানকে সাবান প্রস্তুতিতে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। 'দাদু-দিদার বলা কথাগুলো আমার মনে ছিল। সেই সঙ্গে জাপান থেকে জৈব পদ্ধতিতে কৃষিকাজ শিখে আসা কয়েকজনের কাছ থেকে আরও জানতে পেরেছিলাম। সব মিলিয়ে ঠিক কীভাবে এগোতে হবে তার একটা ধারণা হয়েছিল,' বললেন উদ্যোগপতি জিনা। শুধুমাত্র মণিপুরের বাসিন্দাদের কাছেই নয়, সেখানে বেড়াতে আসা বিদেশী পর্যটকদের কাছেও এই ভেষজ সাবান আজ সমানভাবে জনপ্রিয়।
আজ তাঁর ব্যবসা অনেক দূর এগিয়েছে। তবে জিনা খুমুজামের স্মৃতিতে আজও ভেসে ওঠে সাবান প্রস্তুতির সেই প্রথম দিনটির কথা। খাবার না খেয়ে একশো টাকা জমিয়েছিলেন। শুধুমাত্র সাবান তৈরির কাজ শুরু করবেন বলে। জিনা বলেন, 'আমরা গরিব ছিলাম। কিন্তু আমি কোনওদিন বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন কারও কাছে টাকার জন্য হাত পাতিনি। আত্মসম্মানের সঙ্গে আপোস করতে শিখিনি আমি।'
জিনা খুমুজামের বায়োডেটায় লেখা তিনি ম্যাট্রিক পাশ। ম্যাট্রিকের পর যে পড়াশুনো করেননি তা নয়। তবে দাম্পত্য কলহ তাঁর জীবনকে সবদিক থেকে টালমাটাল করে দিয়ে গিয়েছে। জিনার স্বামী সংসারের দায়িত্ব পালন করেননি। জিনা যখন নিজের কাঁধে সব দায়িত্ব তুলে নিতে চেয়েছেন তখনও স্বামীর প্রবল বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাঁকে। স্ত্রী যাতে নিজের পায়ে দাঁড়াতে না পারেন তা নিশ্চিত করতে অধিকাংশ শংসাপত্রে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলেন জিনা খুমুজামের স্বামী। ডিগ্রি থাকলেও এখন তাই ম্যাট্রিক পাশের শংসাপত্রই তাঁর একমাত্র সহায়। কাজ শুরু করার পরেও পদে পদে বাধা পেয়েছেন। জিনিস তৈরির কাঁচামাল কিনতে যাওয়ার অনুমতিটুকুও মিলত না স্বামীর কাছ থেকে। তবে জিনা তাঁর লড়াই থামাননি। বরং এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও তাঁকে মানসিকভাবে শক্ত হতে শিখিয়েছে তাঁর কাজ।
আজ জিনা খুমুজাম নিজেকে একজন উদ্যোগপতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। দুই মেয়ে এবং ছেলের বউয়ের সহায়তায় প্রতিদিন ৮০ থেকে ৯০টি সাবান তৈরি করেন তিনি। বছরখানেক হল জিনা তাঁর স্বামীকে হারিয়েছেন। তবে তিনি থাকাকালীনই জিনা নিজেকে সফলভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। সাবান তৈরির পাশাপাশি জিনা নিজের এলাকার বিধবা মহিলাদের সাবান তৈরির প্রশিক্ষণও দিয়ে থাকেন। জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা তাঁকে শিখিয়েছে, প্রত্যেক মহিলার স্বাবলম্বী হয়ে ওঠা কতখানি প্রয়োজন। জিনা খুমুজামের মাসিক রোজগার প্রায় দশ হাজার টাকা। তবে বিদেশী পর্যটকেরা অনেক সময় একসঙ্গে অনেক সাবান কিনে নিয়ে যান। সেক্ষেত্রে একটু বেশী রোজগার হয়। অনলাইনেও বিক্রি হয় জিনার প্রস্তুত করা সাবান। তাঁকে সাহায্যার্থে এগিয়ে এসেছে National Innovation Foundation।
সরকারি কোনও প্রকল্প বা ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিতে পারলে হয়তো জিনার ব্যবসার পরিধি আরও বাড়তে পারত। 'বেশ কয়েকবার এধরণের সাহায্য চাইতে গিয়েছি। তবে যেভাবে ঋণ চাইতে গেলে কার্যত জেরা করা হয়, তা আমার ভালো লাগেনি। এই পদ্ধতি এত জটিল না হলে ভালো হতো। আমি চাই এদেশের বিত্তশালী মানুষজন দরিদ্রদের সাহায্যার্থে খোলা মনে এগিয়ে আসুন,' বলে ফোন রাখলেন ষাটোর্ধ্ব উদ্যোগপতি, জিনা খুমুজাম।