নম্বরপ্লেটে "জোড়-বিজোড়" তত্ত্ব দিল্লি দূষণের দাওয়াই!

নম্বরপ্লেটে "জোড়-বিজোড়" তত্ত্ব দিল্লি দূষণের দাওয়াই!

Wednesday December 09, 2015,

5 min Read

আমি ভাবতাম জলবায়ু আর পরিবেশগত সমস্যা কেবলমাত্র ইংরেজি বলিয়ে এলিট শ্রেণির লোকেদের আলোচ্য বিষয়। ভাবতাম সাধারণ মানুষে কাছে এর চাইতে জরুরি অনেক আলোচনার বিষয় আছে। কিন্তু আজ আমাকে মানতেই হবে আমার ধারনা ভুল ছিল। সাম্প্রতিককালে অড-ইভন ফর্মূলা বা জোড় বিজোড় পদ্ধতি মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। অন্য কোনও ইস্যু জনমানসে এত আলোড়ন ফেলেনি। দিল্লি হাইকোর্ট রাজধানীকে গ্যাস চেম্বারের সঙ্গে তুলনা করার পর দিল্লির আপ সরকার এই পরিবেশগত জরুরি অবস্থার মোকাবিলার জন্য এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারপর থেকে হঠাৎ করেই সবাই এইসব বিষয় নিয়ে আলোচোনা শুরু করে দিয়েছেন। এমনকি সাংসদদেরও মুখোশ পরতে দেখা যাচ্ছে।

image


দিল্লির পরিবেশ দূষণ যেরকম ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে, তাতে এরকম জরুরি ভাবেই তার মোকাবিলা করতে হবে। এ নিয়ে তর্কের কোনও জায়গা নেই।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা হু ২০১৪ সালের ১৬০ টি আন্তর্জাতিক শহরের মধ্যে দিল্লিকে সবচাইতে দূষিত শহর বলে চিহ্ণিত করেছে। রাজধানীর আকাশে দূষণের এক কালো মেঘ দেখা যাচ্ছে।শীতকালে এই দূষণ আরও ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করছে। এই পরিস্থিতিতে দিল্লির রাস্তায় একদিন অন্তর জোড় বিজোড় নম্বর প্লেট লাগানো গাড়ি চালানোর দিল্লির আপ সরকারের সিদ্ধান্ত, একটি সঠিক সিদ্ধান্ত। এর ফলে যেকোনও দিন দিল্লির রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা মোট গাড়ির সংখ্যার অর্ধেকই থাকবে। ভারতে যান নিয়ন্ত্রণের এই পদ্ধতি এর আগে কোথাও কাজে লাগানো হয়নি। এ কারণে এই জোড়- বিজোড় ফর্মূলা অনাবশ্যক কৌতুহল ও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়েছে। অনেকেই এর সাফল্য নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তাদের আশঙ্কা চারটি ভাগে ভাগ করা যাবে।

  • যদি এমন কোনও দিন গাড়ির মালিকের পরিবার থেকে কেউ অসুস্থ হন যেদিন গাড়ির নম্বর ব্যান করা নম্বরের তালিকায় রয়েছে, তাহলে কী হবে ?
  • সেইসব বিশেষ ভাবে সক্ষম লোকেদের, যাদের নিজস্ব গাড়ি আছে তাঁদের কী হবে? তাঁদের গাড়ির নম্বর যেদিন ব্যান থাকবে সেদিন তাঁরা কী করবেন? সেই সব লোকেদের পক্ষে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যাবহার করা খুব কঠিন, কারন এখনও এই পরিকাঠামোর ক্ষেত্রে আমরা উন্নত দেশগুলির চাইতে খুব পিছিয়ে।
  • কর্মরত মহিলারা যারা অনেক রাতে নিজের গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফেরেন তাঁদের নিরাপত্তার কী হবে, তাঁরা কী করবেন?
  • এছাড়া সেই সকল অভিভাবকরা যারা অটো বা লোকাল বাসে নয় নিজের গাড়িতেই তাঁদের স্কুলের বাচ্চাদের নিয়ে যাতায়াত করেন তাঁদের কি করণীয়?

এই প্রশ্ন গুলো খুবই ভয়ঙ্কর আর এর সঠিক সমাধান জরুরি। তবে এটাও মানতে হবে, এখনও এবিষয়ে কিছু ধোঁয়াশা আছে। বিরোধী পক্ষের করা সমালোচনা এই ধোঁয়াশা আরও বাড়িয়েছে। আপের একজন প্রতিনিধি হিসাবে আমি আপনাদের একটি কথা বলতে পারি এখনও এবিষয়ে কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। কেবল একটা নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে মাত্র। আর কবে থেকে তা কার্যকর হবে তার দিন ঠিক করা হয়েছে। এছাড়া কিভাবে এটা করা হবে তা ঠিক করতে তিন সদস্যের এক কমিটি গড়া হয়েছে। পরিবহন দপ্তরের মূখ্য সচিব, পরিবেশ দপ্তরের সচিব ও রাজস্ব দপ্তরের সচিব এই কমিটিতে আছেন। এই কমিটি সবার সঙ্গে কথা বলে তাঁদের মতামত, পরামর্শ শুনবে। সব শুনে কিভাবে এই জোড় –বিজোড় ফর্মূলা কার্যকর করা যায় তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। আমি তাই সবাইকে বলব আপনারা কেউ আতঙ্কিত হবেন না। আগে দেখুন কী সিদ্ধান্ত হয়, তারপর আপনার প্রতিক্রিয়া দিন। এছারা পরিকল্পনা রুপায়নের পরও যদি কিছু সমস্যা থেকে যায়। তাহলেও প্রতি দুসপ্তাহে অন্তর যে রিভিউ মিটিং বসবে তাতে এর সমাধান করা সম্ভব।

আমাদের দেশে নতুন হলেও এই পদ্ধতি দুনিয়ার বহু দেশে সফল হয়েছে। অল্প কিছুদিন আগে প্যারিস ও বেজিং এও করা হয়েছে।এছারাও মেক্সিকো শহরে,স্যান্টিয়াগো,বোগোটা,সাও পাওলো লন্ডন, এথেন্স,সিঙ্গাপুর,তেহরান,সান জোস,হন্ডুরাস, লা পাজ এই সব শহরেও এই ফর্মূলা কাজে লাগানো হয়েছে।তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যে এটা সারা বছর চালু থাকবে এরকম চলবে না।এটা জরুরি অবস্থা হিসাবে কাজে লাগানো হয়।এর পাশাপাশি দূষণ রোধের অন্যান্য পদ্ধতি যেমন—জন পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি,দূষণ ছড়ানো কারখানাগুলিকে বন্ধ করা,নাগরিকদের ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত করা এসব করতে হবে।বোগোটায় যেমন সপ্তাহে দুদিন, বেজিং এ সপ্তাহে একদিন এবং সাও পাওলোতে ১৯৯৭ সাল থেকে এই পদ্ধতি চালু রয়েছে। ২০০৮ এর বেজিং অলিম্পিকের সময় কেবল চীনের সরকার দুমাসের জন্য এই ব্যান চালু রাখে।তবে এর জন্য তারা এই সব গাড়ির ভেহিকেল ট্যাক্স তিন মাসের জন্য মকুব করে দিয়েছিল।

প্রত্যেকটা শহরেরই তার নিজস্ব একটা মডেল রয়েছে। এথেন্স যেমন শহরের এলাকাকে দুভাগে ভাগ করেছে।সবসময়ই শহরের দূষণের দিকে নজর রাখা হচ্ছে।দূষণ নির্দিষ্ট মাত্রা ছাড়ালেই রেডিও টিভিতে এই জোড় বিজোড় পদ্ধতি চালু করার কথা ঘোষণা করা হয়। শহরের ভিতরের অংশে ব্যক্তিগত গাড়ির চলাচল পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়, শুধু ট্যাক্সি জোড়-বিজোড় পদ্ধতি মেন চলে। আর শহরের বাহিরের অংশে ট্যাক্সি চলাচল স্বাভাবিক রাখলেও ব্যক্তিগত গাড়ি জোড় --বিজোড় পদ্ধতি মেনে চলাচল করে। কিছু শহরে এটা সারাদিন চালু থাকে। আবার কিছু শহরে ব্যাস্ত সময়ে যেমন ৮.৩০-১০.৩০ আর ৫.৩০-৭.৩০ অবধি চালু থাকে।কিছু লোক এই নিয়ম সারা দিন চালু থাকবে বলে একটা আতঙ্ক সৃস্টি করার চেষ্টা চালাচ্ছেন।এটা সত্যি নয়।প্যারিস যেখানে এই নিয়মের কড়াকড়ি সবচাইতে বেশী সেখানেও এটা সকাল ৫.৩০ থেকে রাত ১১.৩০ টা অবধি জারি থাকে।

লন্ডন, স্টকহোমের মত শহরগুলি তাদের জন পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতির পাশাপাশি আর একটি নিয়ম চালু করেছে।এটি হল লো এমিশন জোন মডেল।এই শহরগুলিতে শহরের মাঝে একটি নির্দিষ্ট মাত্রার বেশী দূষণ ছড়ানো গাড়ি চলাচল পুরোপুরি নিষিদ্ধ।কেউ নিয়ম ভাঙলে বিরাট অঙ্কের ফাইন দিতে হয়। এছাড়াও কম দূষণের গাড়ি কিনতে নাগরিকদের উৎসাহিত করে সরকার। পার্কিংফিও খুব চড়া।লন্ডনে পার্কিং ফি খুব বেশী।আগে ঘন্টাপ্রতি পাঁচ পাউন্ড থাকলেও বর্তমানে তা বেড়ে ১০ পাউন্ড হয়েছে। এভাবে লন্ডনের দু বিলিয়ন পাউন্ড আয় হয়েছে যা আবার পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ণেই কাজে লাগানো হয়েছে।সিঙ্গাপুরে এরকমই গাড়ির লাইসেন্স আর জায়গার লাইসেন্স নিতে হয়।সিঙ্গাপুরে কাউকে গাড়ি কিনতে হলে তার সঙ্গে একটি গাড়ি কেনার লাইসেন্সও কিনতে হয়। যেটা গাড়ির চাইতেও অনেকাংশে দামী।আবার কোনও বিশেষ এলাকায় ঢুকতে গেলে তারও আলাদা টাকা লাগে।বেজিং এ আবার গাড়ির রেজিস্ট্রেশন লটারির মাধ্যমে হয় ।এর ফলে কখনই একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক গাড়ির বেশী রাস্তায় নামতে পারে না।

এরকম বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে রাস্তার গাড়ির সংখ্যা নিয়ন্ত্রিত হয়।এগুলির মধ্যে জোড়-বিজোড় ফর্মূলা এমন একটি ফর্মূলা যা পরিবেশ দূষণগত এমার্জেন্সির সময় দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে।দিল্লি নিজের মত করে দূষণরোধের চেষ্টা করলেও, তাকে পৃথিবীর অন্যান্য শহরের দূষনরোধের মডেলগুলি থেকে শিখতে হবে।একটি নতুন দিনের শুরু হয়েছে বলেই আমার আশা। এই শুরু করাটাই যথেষ্ট সাহসী পদক্ষেপ ও তার উদ্দেশ্যও খুবই সুন্দর।আমাদের এই প্রচেষ্টাকে সফল করতে হবে।আর সেটা তখনই সম্ভব ,যদি আমরা দিল্লির লোকেরা আমাদের ভবিষ্যতকে সুন্দর করতে নিজেদের জীবনযাত্রায় একটু বদল আনি।

(রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিক আশুতোষ এই নিবন্ধের লেখক। মতামত লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত। অনুবাদ সুজয় দাস।)