স্বপ্ন দেখতে শেখায় ইন্দিরা দিদিমনির পাঠশালা

স্বপ্ন দেখতে শেখায় ইন্দিরা দিদিমনির পাঠশালা

Wednesday March 09, 2016,

3 min Read

স্থান, কাল, পাত্র, বয়স, লিঙ্গ, জাতি, শিক্ষা, অর্থ... আকাশ যেখানে সীমাহীন। সবার জন্য অবারিত দ্বার। শুধু পুঁথিগত বিদ্যা নয়। মানুষ হওয়ার, মানুষ গড়ার ব্রত। তাঁকে আঁকড়েই 'বাঁচবো-বাঁচবো' আজ স্বপ্ন তৈরির ঠিকানা। জলপাইগুড়ির ইন্দিরা সেনগুপ্তের হাত ধরে তাই আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখে মানিক, স্বপনের সন্তানেরা।

image


সত্তর পেরনো মানুষটি কালের নিয়মে বৃদ্ধা। এই বয়সেও প্রাণশক্তিতে হার মানায় তারুণ্যকে। কেউ ডাকেন বড়মা বলে, কারও কাছে তিনি ইন্দিরা দিদিমনি। জলপাইগুড়ি রাষ্ট্রিয় বালিকা বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা ইন্দিরা সেনগুপ্ত। মানুষ হওয়া আর মানুষ গড়ার ব্রত নিয়ে তাঁর পথ চলা শুরু অনেকদিন আগে। ২০০২ এ হল স্বপ্নপূরণ। প্রাণ পেল ইন্দিরাদেবীর ব্রেন চাইল্ড 'বাঁচবো-বাঁচবো'।

শুরুর পথটা মোটেও মসৃণ ছিল না। আর্থিক প্রতিকূলতা ছিলই। এলাকার ছেলেমেয়েদের বইমুখী করার পিচটাও ছিল বাউন্সে ভরা। হার মানেননি ইন্দিরা। এক,দুই করে ক্রিজে থিতু হয়েছেন, কখনও সুযোগের অপেক্ষা করতে হয়েছে। যখন দেখছেন হাত খোলা যায়, ছক্কা হাঁকিয়েছেন। প্রতিকূলতার কঠিন বলকে একের পর এক ছক্কা হাঁকিয়ে স্বপ্নগুলিকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন রাষ্ট্রিয় বালিকা বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষিকা। ধৈর্য্য ধরেছেন।তার ফলও মিলেছে। এখন তাঁর সংস্থায় পড়ুয়ার সংখ্যা ২০। স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরাও এসে দাঁড়িয়েছেন ছোটখাট গড়নের এই দিদিমনির পাশে। কেউ আর্থিক সাহায্য দেন। কেউ ছেলেমেয়েগুলোকে পড়ানোর দায়িত্ব নিয়েছেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুরনো বই, পোশাক সংগ্রহ করে ছোটছোট ছেলেমেয়েগুলো।

ওদের কেউ রিকশাচালক। কারও চায়ের দোকান। কেউ কাগজ বেচে সংসার চালান। চান, নিজেদের দুর্ভাগ্য বয়ে বেড়াবে না সন্তানরা। ইচ্ছের সঙ্গে লড়াইয়ে পেরে ওঠে না রেস্ত। দারিদ্রের সঙ্গে নিত্য কুস্তিতে হারিয়ে যেতে বসেছিল স্বপ্নগুলি। সত্তরোর্ধ্ব ইন্দিরা দিদিমনির হাত ধরে এখন ওদের ছেলেমেয়েরা স্কুলমুখী। শুধু বইয়ের পড়া নয়। 'বাঁচবো-বাঁচবো'র ছোট্ট গন্ডিতে মানুষ হওয়ার, মানুষ গড়ার শিক্ষা পায় ওরা।

image


দিদিমনি বই পড়ান, লেখান, শেখান। আর শেখান পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে আরও অনেক বড় জগৎ আছে। কিশলয় মনের মেধা ও প্রতিভার আত্মপ্রকাশের সুযোগ করে দিতে শেখানো হয় স্তশিল্পের কাজ। মহড়া চলে নাটক, গান, নাচ, আবৃত্তি ও নাটকের। পুজো, পয়লা বৈশাখ, রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী, সংস্থার বার্ষিক উৎসবের আয়োজন হয় সংস্থারই ছেলেমেয়েদের নিয়ে। অনুষ্ঠান ঘিরে মেলার আয়োজন। প্রদর্শনীতে থাকে তাদেরই হাতের তৈরি নানা জিনিসপত্র। আনন্দমেলায় সামিল হন শহরের নানা শ্রেণি ও সংস্থার মানুষজন। মেলা বসে নয়াবস্তি পাড়ায়, রাষ্ট্রীয় বালিকা বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা, বয়স যাঁকে হার মানাতে পারে না, সেই ইন্দিরা সেনগুপ্তের শাল, সেগুন, শিশু গাছে ঘেরা অঙ্গণে। ডালিয়া চৌধুরী, দেবাশিস সরকারের মতো শিল্পীদের তালিমে, তাঁদের তৈরি করা মুখোশ, কার্ড, ফুলদানি, সেলাই, ঠোঙা আর দেওয়াল পত্রিকা ও অজস্র ছবিতে অন্য চেহারা নেয় প্রতিদিনের চেনা একফালি উঠোন।

মেলা প্রাঙ্গনে বসে সবার সঙ্গে খোলামনে কথা বলেন ইন্দিরাদেবী। স্বপ্নের খোঁজ করেন। মানুষ দেখেন, দেখেন নিজের হাতে তিল তিল করে গড়ে তোলা কচি মুখগুলোর মুখে হাসির ফোয়ারা। আরও আরও অনেক নতুন স্বপ্নেরা ভিড় করে মনে। এক কদম দু কদম করে আরও এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা খোঁজেন মানুষের ভিড়ে।