কলকাতাকে চিনতে শেখাচ্ছে 'Daily Mirage'

কলকাতাকে চিনতে শেখাচ্ছে 'Daily Mirage'

Sunday November 08, 2015,

4 min Read

ছোট থেকেই শুনে আসছি কলকাতার আর এক নাম 'City of Joy'। জীবনানন্দ লিখেছিলেন "কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে"। শঙ্খ বাবুর বক্তব্য, "এ কলকাতার মধ্যে আছে আরেকটা কলকাতা"। আর এই বছরচারেক আগে 'পরিবর্তন'-এর জোয়ার যখন এল, নতুন আলোয় সাজতে শুরু করল শহর তখন গঙ্গার ধারে বাগান হল। পাণ্ডববর্জিত বলে এক সময় টিপ্পনি পাওয়া নিউটাউনে তৈরি হল ইকো পার্ক। জলের ওপারে ইন্দ্রপ্রস্থের হাতছানি। রমরমিয়ে সাদা নীল আলোয়, রঙে সেজে উঠল শহরের আনাচ কানাচ। রাস্তাঘাট, হ্যারিসন রোড ছোটে তার পিছে পিছে। মেক ওভারের এমনই হিড়িক। শোনা গেল কলকাতায় কোথাও একটা 'কলকাতা আই'-ও হবে। তখন সবার মুখে একটাই কথা, কলকাতা এবার লন্ডনের মতো রূপসী হল বলে। তা, যে যা বলে বলুক। কলকাতার তাতে থোড়াই কেয়ার। নিন্দুকের মুখে ছাই দিয়ে কলকাতা আছে কলকাতাতেই।

তবে কলকাতার ভেতর যে সত্যি একটা কলকাতা থাকতে পারে সেটাই আবিস্কার করতে উঠে পড়ে লেগেছেন এ শহরের দুই তরুণ আর এক তরুণী। নিজেদের ব্লগ 'Daily Mirage'-এর মধ্য দিয়ে ওঁরা খুঁজে পেতে চান তাঁদের ভালোলাগার শহরকে।

image


অর্পিতা, দেবরাজ এবং অরুণ। আপাতদৃষ্টিতে তিনজন তিনটে আলাদা জগতের মানুষ। কিন্তু তিনজনেরই ভালোলাগার জায়গাটা এক। তাঁরা সকলেই লিখতে ভালোবাসেন।

অর্পিতা দেব, এই তিনমূর্তির একমাত্র মহিলা সদস্য। বই পড়া, ঘুরে বেড়ানো, নানা স্বাদের খাবার চেখে দেখা থেকে শুরু করে সিনেমা দেখা, অর্পিতার ভালোলাগার তালিকাটা একটু লম্বা। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু ভালোবাসেন শুধুই লিখতে। খুব শিগগিরই নিজের প্যাশনকে প্রফেশনে বদলাতে চান অর্পিতা। 

আর অরুণ শাহ - শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে প্রশিক্ষণ নেওয়া সাইকোলজির ডিগ্রিধারী একজন ডিজে। নিজের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থাও রয়েছে। তবে সব বাদ দিয়ে যেটা তাঁর কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তা হল লেখার ইচ্ছে। নিজের সমস্ত অভিজ্ঞতা সকলের সামনে তুলে ধরতে তাঁর সহায় কলম, থুড়ি কি-বোর্ড। 

এই ট্রায়োর তৃতীয় সদস্য দেবরাজ লাহিড়ি। প্রয়োজন ছাড়া কথা বলা তাঁর নাপসন্দ। আর সব না বলা কথাই তিনি বলতে চান লেখার মধ্য দিয়ে। আদতে আইটি ইঞ্জিনিয়ার।

তিনজন যখন এক ছাদের তলায় আসবেন, তখন যে সৃষ্টিশীল কিছু হবে তা তো বলাই বাহুল্য। আর ঠিক সেটাই হয়েছে। খুলে ফেলেছেন ব্লগ। নাম 'Daily Mirage'। ব্লগের নাম যে সার্থক, তা একবার চোখ বোলালেই বোঝা যায়। নতুন স্বাদের খাবার থেকে শুরু করে লিঙ্গবৈষম্য হোক বা হালের সারদা দুর্নীতি - সব বিষয়েই দেবরাজ, অরুণ, অর্পিতাদের ভাবনাচিন্তার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠছে তাঁদের ব্লগে।

image


গত কয়েকবছরে নিজেদের মতামত প্রকাশের মঞ্চ হিসেবে অনেকেই বেছে নিয়েছেন ব্লগ কে। অমিতাভ বচ্চন থেকে শুরু করে লেডি গাগা - ব্লগের দুনিয়ায় উঁকি মারলেই দেখা যাবে, সেলিব্রিটি ব্লগারের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। আর সাম্প্রতিককালে, যেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে দেশ তোলপাড়, তখন নতুন প্রজন্মের হাতিয়ার হয়ে উঠতেই পারে তাদের ব্লগ। তবে Daily Mirage-এর ব্লগের কিন্তু নিজস্ব মতপ্রকাশের পাশাপাশি বেশ কিছু উদ্দেশ্য রয়েছে। যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কলকাতা শহরকে একেবারে অন্যরকমভাবে মানুষের সামনে তুলে ধরা। "কলকাতা মানে যে শুধু ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল আর বিড়লা প্ল্যানেটারিয়াম নয়। কলকাতার গলিখুঁজিও কথা বলে। সেই কথাগুলোই মানুষকে শোনাতে চাই আমরা।" বললেন এই ব্লগের সহ-প্রতিষ্ঠাতা অর্পিতা দেব। শতাব্দী প্রাচীন এই শহরের পরতে পরতে ইতিহাস। আজীবন এই শহরেই কাটিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও সেই ইতিহাসের বেশিরভাগটাই শহরবাসী জানতে পারেন না। আর সেই অদেখা, অচেনা কলকাতাকে চিনতেই 'Daily Mirage'-এর শাখা 'Kolkata Connect'। খুব শীঘ্রই যা যোগ হতে চলেছে ব্লগের পাতায়। এই শহরকে নিয়ে আপনার নস্ট্যালজিয়া আপনিও সকলের সঙ্গে শেয়ার করতে পারেন এর মাধ্যমে।

image


একথা সবাই জানে যে বাঙালিমাত্রই বেড়াতে ভালোবাসে। তা দেশ-বিদেশের নানা প্রান্তে আপনি ঘুরে বেড়ান। আমরা বারণ করব না। কিন্তু নিজের শহরটাকে তো চিনতে হবে। আর সেই সুযোগটাই, মাউসের কয়েকটা ক্লিকের সাহায্যে আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চলেছে এই উদ্যোগ।

তবে শুধু শহরের না বলা কথা খুঁজে বের করা নয়, এই শহরের মানুষের কাছেও পৌঁছতে চান 'Daily Mirage'-এর সদস্যরা। এক্ষেত্রে তাঁদের অনুপ্রেরণা 'Humans of New York' এবং 'Humans of Mumbai'। এমন অনেক মানুষ এখানে রয়েছেন যাঁরা সাধারণ হওয়া সত্ত্বেও অসাধারণ। যাঁরা নিজেদের মতো করে প্রতিনিয়ত এই শহরকে, শহরের মানুষকে কিছু না কিছু দিয়ে চলেছেন। প্রচারের আলোর কণামাত্র যাঁদের উপর কোনওদিনও পড়েনি। সেই মানুষগুলোকেই জনসমক্ষে নিয়ে আসতে চান অর্পিতারা। সত্যিই তো, নিউ ইয়র্ক যা পেরেছে, মুম্বই যা পেরেছে, তা আমাদের কলকাতা পারবে না কেন? 

'Daily Mirage'-কে নিয়ে এই ট্রায়োর পরিকল্পনার শেষ নেই। কিছুদিনের মধ্যেই শহরের বিভিন্ন হানাবাড়ি তে হানা দিতে চান তাঁরা। না, না ভয় পাবেন না। এই একটু অ্যাডভেঞ্চার আর কী। শহরের বিভিন্ন হন্টেড প্লেসে শহরবাসীকে নিয়ে ট্যুরের ব্যবস্থা করতে চলেছে এই সংস্থা। কলকাতাকে শহরবাসীর কাছে আরও আপন করে তোলার জন্য অনেক কিছুই করতে চান অর্পিতা, অরুণ এবং দেবরাজ। তবে সবটাই নির্ভর করছে পুঁজির উপর।

গত তিন-চার মাসে ব্লগের পুরো খরচটাই নিজেদের জমানো টাকা থেকে করে চলেছেন তাঁরা। দেশের Intellectual Hub কলকাতা। অথচ, এখনও ব্লগ লেখার ক্ষেত্রে এই শহর তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি। দেবরাজ, অরুণরা জানেন, কোনও নতুন উদ্যোগকে সফল করে তুলতে ধৈর্য ধরতেই হবে। তবে বিনিয়োগেরও প্রয়োজন আছে। সেই কারণেই সব কথার শেষে শহরবাসীকে এই উদ্যোগে এগিয়ে আসার অনুরোধ জানিয়েছেন অর্পিতা। তিনি বলেন, "আমরা চাই ইওর স্টোরির মতো উদ্যোগ আমাদের পাশে থাকুক। আমরা চাই মানুষ আমাদের সম্পর্কে জানুন এবং আমাদের পাশে থাকুন। তবেই আমরা সফল হতে পারব।"