চরকার সুতোয় বাঁধা মার্কিন শিল্পী অ্যারন সিনিফ্ট
Monday October 23, 2017,
4 min Read
১৯৯৩ সাল। ছুটিতে বেনারস ঘুরতে এসেছিলেন নিউইয়র্কের বছর চব্বিশের এক শিল্পী। নাম অ্যারন সিনিফ্ট। কিন্তু তাঁর জীবনটাই পাল্টে দিয়েছিল একটা ‘ঝোলা’। এতটাই যে তিনি ভারতের প্রেমে পড়ে গেলেন। ভারতের রঙ, রূপ, সংস্কৃতির প্রেমে রীতিমত হাবুডুবু খেলেন এই মার্কিন যুবক। শিখে ফেললেন হিন্দি। সারা দেশে যত গান্ধী আশ্রম রয়েছে ঘুরে ঘুরে বেড়ালেন বছরের পর বছর।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের কাহিনিতে মুগ্ধ হলেন। এবং গৌতম বুদ্ধ আর মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে তৈরি করে ফেললেন তার নিজের জীবন। মূলত গান্ধীকে ধ্রুবতারা মেনে ঘুরিয়ে দিলেন তাঁর জীবনে মোড়। গান্ধীকে নিয়ে নানান অপপ্রচারের পানা শ্যাওলা সরিয়ে সত্যিকারের সর্বোদয়ের ভাবনার জনক মহাত্মা গান্ধীকে জানতে পড়ে ফেললেন গাদা গাদা বই। নেমে পড়লেন এক বিশাল কর্মযজ্ঞে। অ্যারন সিনিফ্ট। মার্কিন এই শিল্পী ঝোলা আর্ট এবং খাদির কারিগরদের বাঁচিয়ে রাখতে 5 Year Plan নামে একটি প্রকল্প শুরু করলেন। তার পাশাপাশি দুটি বইও প্রকাশ করে ফেলেছেন এই অনুপুঙ্খ লেখক।
এদেশের গরিব মানুষের দুর্দশায় বিচলিত বোধ করতেন এই ভিনদেশী প্রেমিক। খাদি বুনে অন্ন সংস্থানের পথ দেখিয়েছিলেন গান্ধীজী। গ্রামের উন্নয়নের ভিতর দিয়ে সমগ্র দেশ জাতীর উন্নয়নের স্বপ্ন দেখতেন তিনি। সম্পদের সমৃদ্ধির কেন্দ্র মুখীনতা নয়, বরং কেন্দ্রবহির্মুখী সম্পদ বণ্টনের থিওরি পড়ে রীতিমত গান্ধীর আদর্শের প্রতি অনুগত হয়ে পড়েন। জীবন বয়ে যায় একেবারে সাদা মাঠা ত্যাগের ভাবনাকে সঙ্গে নিয়ে।
যদিও খাদি আর গান্ধীজীর আদর্শের বিন্দু বিসর্গও ভারতে আসার আগে জানতেনই না অ্যারন। কিন্তু ভারতীয়ত্বের প্রতি কৌতূহলই ধীরে ধীরে মহাত্মা গান্ধী সম্পর্কে ধারণা তৈরি করিয়েছে। বেনারসের কোনও দোকানে ঝোলানো গান্ধীর ছবি আঁকা খাদির ঝোলা ব্যাগ কিনেছিলেন। ঝোলা ব্যাগটাই তাঁকে নিয়ে গিয়েছে গান্ধীর দরজায়। মার্কিন এই শিল্পী গান্ধী আশ্রম ঘুরে ঘুরে খাদির গরিব কারিগরদের খোঁজ নিতে শুরু করেন। তিনি মনে করেন খাদি ভীষণ সুন্দর, একটি লাগাতার আর দুর্দমনীয় একাগ্রতার শিল্প। গান্ধী নিজে চরকা কাটতেন, বুনতেন, পরতেন, ফলে এর মাহাত্ম্যই অ্যারনের কাছে অন্যরকম ছিল। মোটা খাদির একটি ঝোলা ব্যাগ দেখার পর থেকেই এর উৎস জানার ইচ্ছে হয় অ্যারনের। শুরু করে দেন মামুলি কাপড়ের ব্যাগের রিচার্সওয়ার্ক। আশ্রমের অনামা শিল্পীরা সাধারণ মানুষের জন্য যে শিল্প তৈরি করতেন সেটাই তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল। মাটির গন্ধ লেগে থাকা এই শিল্পই আদতে পপ আর্ট, বলছিলেন ভারতীয়ত্বে মুগ্ধ অ্যারন। বোস্টন ইউনিভার্সিটির এই ছাত্র নিজের স্টুডিওর দেওয়ালে ঝোলাটা ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন। বুঝতে পারছিলেন তাঁর রঙিন ক্যানভাস ধীরে ধীরে ‘ঝোলা’ থিমের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। তাঁরই শিক্ষক জন ওয়াকার বলেছিলেন, ‘ব্যাগটা শুধু হস্তশিল্প নয়, শিল্পের জীবন্ত প্রতীক’। মাস্টারমশাইয়ের শব্দ-বন্ধগুলি মনে গেঁথে গিয়েছিল সিনিফ্টের। সেই তখন থেকেই স্থির হয়ে গিয়েছিল শিল্পীর পরবর্তী কর্মপন্থা।
New York gallery, Feature Inc তে চাকরিও করেন সিনিফ্ট। শিল্পী হিসেবে অভাবী শিল্পীদের পাশে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। একটা গোষ্ঠী গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন যেখানে প্রত্যেকে প্রত্যেকের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারবেন। সিনিফ্ট গান্ধী আশ্রমগুলির কাছে খাদি কাপড়ের বই তৈরির আবেদন জানান। বইয়ে ৮ দেশের ২৪ জন নামী শিল্পীর ব্লকপ্রিন্টের আর্ট-ওয়ার্ক রাখা থাকবে। নিজে উদ্যোগ নিয়ে ফ্র্যান্সিসকো ক্লেরমনেট, ইয়োকো ওনো এবং ক্রিস মার্টিনের মতো প্রতিথযশা শিল্পী এবং তামারা গোঞ্জালেস, পুষ্পা কুমারীদের মতো তরুণ শিল্পীদের একত্রিত করে বইয়ের এক একটা পাতায় নিজেদের অবদান রাখার আহ্বান জানান। এই পরিকল্পনাকে তিনি নাম দেন “Five-Year Plan”। ১৮০ কপি ছাপানোর পরিকল্পনা করেন যার প্রত্যেক কপি থাকবে এক একটি হাতে তৈরি ঝোলা ব্যাগে। খাদি কারিগরদের উন্নয়নে খরচের জন্য অনলাইনেই অর্ধেক ফান্ড তুলে নিয়েছিলেন অ্যারন যার। এটা ছিল শুরু। এই প্রকল্পকে আরও এক ধাপ এগিয়ে জৈব চাষিদের কাছে পৌঁছে যেতে চান তিনি। পরিকল্পনা হল সারা দেশের জৈব চাষিদের দিয়ে তুলা চাষ করিয়ে সেখান থেকে সুতো তৈরির পর খাদি বোনার কাজ শুরু করা। এই কাজের জন্য চাষি, চরকায় সুতো তৈরির কারিগর, তাঁতিদের একসঙ্গে করে একটা জোট তৈরি করে দিতে চেয়েছিলেন।
এভাবে এক যুগের বেশি সময় কেটে গিয়েছে। সম্প্রতি ঝোলা আর্টে আর ১৪০০ মিটার খাদি দিয়ে তৈরি দ্বিতীয় বই প্রকাশ করেছেন অ্যারন। নবম বার ভারতে এসে Studio21 এ একটি প্রদর্শনীতে খাদি প্রকল্পের দ্বিতীয় বই Other Imaginings প্রকাশ করেন। ঝোলা আর্টের নানা নমুনা দর্শকরা ডোভার ট্যারেস গ্যালারির প্রদর্শনীতে দেখতে পারেন। খাদি কুর্তা আর গলায় গামছা জড়িয়ে অ্যারন সিনিফ্ট বইয়ের উদ্বোধন করলেন। আর আগত শ্রোতাদের বলছিলেন নিজের জীবনের গল্প। ঝোলার ওপরে আঁকা দেখে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন। বেশিরভাগ শিল্পী অপরিচিত। আরও অবাক হয়ে গিয়েছিলেন বুঝতে পেরে যে এমন সুন্দর শিল্প যার সঙ্গে গান্ধী আশ্রম জড়িয়ে সেগুলি সংরক্ষণের কোনও ব্যবস্থা নেই! ক্ষোভ ঝড়ে পড়ে অ্যারনের গলায়। কলকাতার বিশিষ্ট শিল্পী সুমিত্র বসাক সহ মেক্সিকো, জার্মানি, আমেরিকার প্রায় ১৬ জন শিল্পীকে দ্বিতীয় বইয়ে একত্রিত করতে পেরেছেন অ্যারন। মাল্টিমিডিয়া আর্টিস্ট ওকো ওনো এবং জন লেননের স্ত্রীকেও এই প্রোজেক্টে সামিল করতে পেরেছেন এই শিল্পী। ‘বইয়ের কিছু কিছু কাজ সামাজিক সমস্যা তুলে ধরেছে। কিন্তু বেশিরভাগই কয়েক বছর ধরে আকবরপুরের গান্ধী আশ্রমে ফেলে রাখা স্তূপ অথবা আসল ঝোলা থেকে নেওয়া ছবির স্ক্রিন প্রিন্ট অথবা উডব্লক’, জানান সিনিফ্ট। খুঁজে পাওয়ার এ এক অপার আনন্দযাত্রা। অন্যরকম কিছু একটা করতে পেরে গান্ধী আশ্রমের শিল্পীরা উদ্দীপিত। তিনিও ভারতীয় জনজীবনের স্বাদ পেয়েছেন। বিশেষ করে আশ্রমিকদের এবং তাঁদের শিল্পের এহেন স্বীকৃতিই মার্কিন এই শিল্পীর তৃপ্তি।