বঙ্গদেশে ইংরেজি নাটক ! চমকে দিচ্ছে থিয়েট্রিসিয়ান
Wednesday October 07, 2015,
3 min Read
তিন মাথা এক হলে অনিবার্য ঠোকাঠুকি। তার ওপর কলকাতাইয়া হলে তো কথাই নেই। তথাগত চৌধুরী, কনক গুপ্তা এবং ধ্রুব মুখার্জি। তাঁরা আলোচনায় বসলে মতভেদ হয়, উচ্চকিত হয় কণ্ঠস্বর। কিন্তু ঠোকাঠুকি? নৈব নৈব চ। আসলে উদ্দেশ্য যেহেতু এক, তাই তিনজনই একই পথের পথিক। চিন্তায় থিয়েট্রিসিয়ান, কর্মেও থিয়েট্রিসিয়ান। সবাই যেন গিরিশ ঘোষের চ্যালা। ‘‘লোকে মন্দ বলে বলুক, আমি থিয়েটার ছাড়ব না।’’ এমনই ধনুক ভাঙা পণ।
পাঠক, এতদূর শুনে হয়তো ভাবছেন, কলকাতায় নাটক হয়েছে, হচ্ছে, হবেও। কত রথী-মহারথীই তো নাটকের মঞ্চ আলোকিত করেছেন। ভবিষ্যতেও করবেন। তবে তথাগত, ধ্রুব এবং কনক নামের তিন কলকাতাইয়ার তৈরি নাট্য দল থিয়েট্রিসিয়ান নিয়ে এত কথা বলার দরকার কী? আসলে থিয়েট্রিসিয়ান হল চ্যালেঞ্জের নাম। প্রচলিত ছক ভাঙার সাহসী চেষ্টা। কিংবা সাফল্যের দুর্দান্ত সংজ্ঞা।
কলকাতা মানে বাংলার মুখ। স্কুল-কলেজে বাংলা, পাড়ার রেয়াকে বাংলা। এ কলকাতায় ইংরেজিতে নাটক করার জন্য পেশাদারি দল গড়ার কথা শুনলে অনেকে বলবেন, ‘‘এর চেয়ে এস্কিমোর দেশে গিয়ে ফ্রিজ বিক্রি করা ঢের ভাল।’’ কিন্তু তথাগত, কনক, ধ্রুবরা প্রমাণ করে দিয়েছেন যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের রুচি, পছন্দ, চাহিদা বদলায়। বিনোদনের মান উঁচু তারে বেঁধে দেওয়া গেলে ইংরেজি নাটকও গ্রহণ করতে প্রস্তুত কলকাতার নবীন প্রজন্ম। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, নাটক হল স্রেফ শখ। অফিস-কাছারি সামলে অ্যাকটিং কর, থিয়েটারি সংলাপ আওড়াও, শাজাহানের পার্ট মুখস্থ কর। কিন্তু পেশা হিসাবে থিয়েটারকে নিতে গেলে অবশ্যই ডুববে। নুন-ভাতও জুটবে না। কিন্তু থেয়েট্রিসিয়ানের তিন মূর্তি ভুল ভেঙে দিয়ে বলছেন, ‘‘নাটক আমাদের ব্রেড অ্যান্ড বাটার।’’ অর্থাৎ নাটকে রুটির সঙ্গে মাখনটাও মেলে।
থিয়েট্রিসিয়ানের জন্ম ২০০০ সালে। তখন ধ্রুব এবং কনক ম্যানেজমেন্ট টিমে থাকলেও দলের মূল দায়িত্বটা তথাগত চৌধুরীর কাঁধে। এর পর তিনটে বছর পেরিয়েছে। ব্রিটেন এমবিএ পড়তে গিয়ে থিয়েটার নিয়ে কণকের ধারণাটাই বদলে গেল। ব্রিটেনের থিয়েটার জগৎ অনেক অনেক বেশি রুঢ়। পেশাদার। শখের জন্য থিয়েটারের কথা শুনলেই তাঁরা বলে ওঠে, ‘‘হয় পুরো সময় দাও, নইলে বিদেয় হও।’’ পাকাপাকিভাবে দেশে ফিরে ধ্রুব এবং তথাগতর সঙ্গে আলোচনায় কনক তুলে ধরলেন নতুন ধারণা। নাটক থাকবে, থাকবে ব্যবসাও। সব মিলিয়ে নাট্য ব্যবসা।
২০০৭ সাল। ইংরেজি নাটক পরিবেশন করার জন্য পেশাদারি নাট্য দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করল থিয়েট্রিসিয়ান। সভাপতির পদে কনক, সচিব তথাগত, হিসাবরক্ষক ধ্রুব। আগে ক্লাবের ফাংশন, কিংবা কলেজ সোশ্যালে ডাক পেলেই মন খুশিতে ডগমগ করত। কিন্তু এবার পেট চালানোর খাতিরে চাই বড় প্রজেক্ট। ধ্রুব মুখার্জি পরিচালিত ‘দ্য বার্থডে পার্টি’ মঞ্চস্থ করার আগেই সুখ্যাতি কুড়িয়েছিল থিয়েট্রিসিয়ান, এবার নাটকের সংখ্যা বাড়তে লাগল।
পেশাদারি জগতে আত্মপ্রকাশের দিনগুলো কেমন ছিল? তথাগত বললেন, ‘‘আমাদের অভিজ্ঞতা ছিল, ভাল কাজের ইচ্ছেও ছিল। কিন্তু পেশাদারি দল চালাতে স্পনসর দরকার, টাকা দরকার। বিজ্ঞাপন দরকার। কেউ সাহায্য করল, কেউ আবার মুখের সামনেই বন্ধ করে দিল দরজা। কিন্তু তারপরও চেষ্টা এবং চেষ্টা।’’ গত চোদ্দ বছরে নেই-নেই করেও নিরানব্বইটা নাটক মঞ্চস্থ করেছে থিয়েট্রিসিয়ান। কোনওটা কলকাতায়, কোনওটা মুম্বই কিংবা দিল্লিতে। কোনওটা আবার এশিয়ার অন্য কোনও দেশ, কিংবা আরও দূরে।
তিন বন্ধুর সংসারে অশান্তি হয় না? প্রশ্ন শুনে তথাগত বললেন, ‘‘হয়। কিন্তু আমাদের মধ্যে যে মতভেদ, তা শিল্পের জন্য। নাটকের জন্য। ব্যক্তিগত কারণে নয়।’’ হয়তো এজন্যই থিয়েট্রিসিয়ানের গাড়ি চলছে গড়গড়িয়ে। কনকের দাবি তাঁদের সাফল্যের মূলে দুটো উপাদান। প্রথমত, তাঁরা কাজ করেন আবেগ দিয়ে। হৃদয় দিয়ে। ছেলেবেলা থেকেই যেহেতু তাঁরা তিনজনই অভিনয়ের স্বপ্ন দেখছেন, তাই তাঁদের চলার পথ এক। প্রত্যেকেরই মনে হয়, থিয়েট্রিসিয়ান বিনা তাঁদের অস্তিত্ব জল ছাড়া মাছের মতো। দ্বিতীয় উপাদান হল, ব্যবসায়িক কৌশল।
২০০৭-২০০৮ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতে বিনোদন শিল্পের বৃদ্ধির হার ১৮ শতাংশ। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের রুচি বদলেছে। বিনোদনের চাহিদা বদলেছে। থিয়েট্রিসিয়ানের নাটক যেন চাহিদার জোগানদার। তথাগত বলেন, ‘‘তুমি যদি প্রথা ভেঙে অন্য কিছু করতে চাও, তবে ভয় পেও না। স্বপ্ন নিয়ে বাঁচ। স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখ।’’
সত্যিই জীবন ভারি বিচিত্র। একটা সময় যারা ছিল বিদ্রুপের পাত্র, কত উপেক্ষা, কত সমালোচনা। তাচ্ছিল্যের শানিত বাণে কত রক্তপাত। আজ কিনা তারাই বীরযোদ্ধা। জনপ্রিয়তার আলোকবৃত্তে থিয়েট্রিসিয়ান। সফল নাটকের কুশীলব তথাগত-ধ্রুব-কনকদের দেখিয়ে অনেকেই বলছেন অসাধ্য নয় কিছুই, চেষ্টা থাকলে সব হয়।