ঐতিহাসিকদের তোয়াক্কা না করেই ১৩৫ বছর ধরে আছেন, থাকবেন মহেন্দ্র দত্ত

ঐতিহাসিকদের তোয়াক্কা না করেই ১৩৫ বছর ধরে আছেন, থাকবেন মহেন্দ্র দত্ত

Tuesday October 24, 2017,

5 min Read

ব্যবসা বাণিজ্যে বাংলার একটা সময় খুবই নাম ডাক ছিল। জাহাজ কিনতেন বাঙালি ব্যবসায়ীরা। গন্ধবণিকদের তো রমরমা ছিলই। পাট, চিনি, লবণ, তাঁতের কাপড় আর অন্যান্য সামগ্রীর সঙ্গে আফিম বিদেশে রফতানি নিয়ে এক হই হই ব্যাপার ছিল বাংলার। ১৭০৮ থেকে ১৭৮৬। ভারতীয় পণ্য কিনতে ইংরেজদের এতো সোনা খসাতে হয়েছে যে তা নিয়ে রীতিমত ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কপালে ভাঁজ পড়ে। কিন্তু ভালো সামগ্রী পেতে তো বাড়তি পয়সা খসাতেই হবে। সেকথাও ব্রিটিশ পার্লামেন্টের দলিলে উল্লেখ আছে। সে সব সময় ছিল বাংলার সোনা ফলানোর দিন। 

প্রথম রাষ্ট্রপতির মাথায় মহেন্দ্র দত্তর ছাতা। অবিভক্ত ভারতে মহেন্দ্র দত্তই প্রথম ছাতা প্রস্তুত কারক সংস্থা। চিত্র: পারিবারিক সূত্রে সংগ্রীহিত

প্রথম রাষ্ট্রপতির মাথায় মহেন্দ্র দত্তর ছাতা। অবিভক্ত ভারতে মহেন্দ্র দত্তই প্রথম ছাতা প্রস্তুত কারক সংস্থা। চিত্র: পারিবারিক সূত্রে সংগ্রীহিত


পাশাপাশি, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ষড়যন্ত্রে মেরুদণ্ড গলানোর দিনও শুরু হয়েছিল। যত সরকারি কাজে কলকাতায় দফতর চালু হতে শুরু করল, অর্ধ-শিক্ষিত যুবকদের দিয়ে খাতা লেখানোটা আয়ত্ত করে নিয়েছিল ইংরেজ সাহেবরা। বাবুয়ানা শুরু হল এভাবেই। কেরানিগিরির তখন তুমুল কদর। রায়বাহাদুর খেতাব পাওয়ার লড়াইয়ে একের পর এক বাগানবাড়ি গজিয়ে উঠল গঙ্গার দু'পাড়ে। বিলিতিদের সঙ্গে ঢলাঢলি, গলাগলি করতে পারলে তৎকালীন বাঙালি বাবুদের আর পায় কে! ১৮৮২ সালে মহেন্দ্র দত্ত যখন সামান্য ছাতার দোকান খুলছেন তখন সেসব ভালো চোখে দেখাই হত না। 

কিন্তু মহেন্দ্র দত্ত নিজের উদ্যোগে খুলে বসলেন কলকাতার বুকে ছাতা তৈরির কারখানা আর দোকান। গুণগত মানে ঢের ভালো। শুধু একটা দোকান বা কারখানাই নয়। নিজের নামে ব্র্যান্ডিংও করলেন মহেন্দ্র দত্ত। সেই ছিল তার স্টার্টআপ। Mohendra Dutt & Sons এই নামে কোম্পানিও খুললেন। বিত্তবান বনেদি বাড়ির ছেলে। কাজ না করাই যেখানে ট্রেন্ড সেখানে মহেন্দ্র দত্ত উদয়াস্ত খাটতেন। স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁর সংস্থার ছাতা কলকাতা থেকে গোটা দেশে ছড়িয়ে যাবে। ইংরেজ বাবু বিবিরা ব্যবহার করবেন, লন্ডন পাড়ি দেবে তাঁর নাম। এর আগে রাজা রামমোহন রায় গিয়েছেন ব্রিস্টল। ব্রিটেনের রানির সঙ্গে সৌজন্যের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে এই দেশের সমাজ সংস্কারকের। ফলে কলকাতার কাছে রাজার বিলেত যাত্রা ছিল গৌরবের বিষয়। সেই বাংলার ছাতা কোম্পানি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বে ছত্রাকের মতো। ১৮৮২ সাল থেকে ১৯০৯। মাত্র সাতাশ বছর চুটিয়ে ব্যবসা করতে পারলেন মহেন্দ্র দত্ত। তাঁর অকাল প্রয়াণের পর গোটা ব্যবসায় কালো ছায়া নেমে আসে। দুই ছেলে ভবানীচরণ আর তারিণীচরণ দুজনেই ছোটো ছোটো। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে স্ত্রী রাধারানী দেবী ব্যবসার হাল ধরেন। অপর স্ত্রীর পরিবারের তরফ থেকে এবং মহেন্দ্র দত্তের আত্মীয়রা কোনও মারোয়াড়ি ব্যবসায়ীর কাছে ব্যবসা বিক্রি করে দিতে চেয়েছিলেন। সেই সময় রাধারানী দেবী রীতিমত আইন আদালত করে, সে গুড়ে বালি দেন। মহামান্য আদালতে রাধারানী জানান তাঁর পরলোকগত স্বামীর ব্যবসা এবং ব্র্যান্ডে তিনি ছাড়া আর কারও অধিকার সিদ্ধ নয়। রীতিমত কাগজ পত্র দেখিয়ে মামলা জিতে নন। ভেবে দেখুন সেই যুগ। যখন সাধারণ বনেদি ঘরের মহিলারা অন্তঃপুরেই ঘুরপাক খেতেন। যাদের খিড়কি থেকে সিংহদুয়ারে গোটা জগত সীমায়িত ছিল। সেই সময়ের এক সদ্য বিধবা মহিলা ঘরের চৌহদ্দির বাইরের দুনিয়ায় রীতিমত কোমর বেঁধে নামলেন, উদ্যোগপতি স্বামীর ব্যবসার হাল ধরলেন। তিনিই চালিয়ে নিয়ে গেলেন ব্যবসা। তিনিই মহেন্দ্র দত্তের ছাতাকে কলকাতার বাইরে প্রশস্ত করলেন। এবং টানা ১৪ বছর ছেলে মানুষ করার পাশাপাশি রাধারানী দেবী সামলে দিলেন বাণিজ্য তরী। ১৯২৩ এ ছেলেরা দায়িত্ব নিলেন। বড় ছেলে ভবানী যখন ব্যবসার হাল ধরেন তখন তার বয়স মাত্র ষোলো কি সতের।

সেই থেকে চলছে মহেন্দ্র দত্ত পরিবারের লেগাসি। কথা হচ্ছিল সেই বংশের তরুণ উদ্যোগপতি শুভাশিস দত্তের সঙ্গে। ওদের পরিবারের কূল দেবতা মাতা সর্বমঙ্গলা পুজোর অনুষ্ঠানের আয়োজনের ইতিহাস বলতে গিয়ে শুভাশিস বললেন, ওদের কঠিন লড়াই আর টিকে থাকার রহস্যের কাহিনি।
(বাম দিক থেকে) শুভাশিস দত্ত পরিবারের নবীন প্রজন্ম, মাতা সর্বমঙ্গলার বিগ্রহ এবং শুভাশিসের পিতামহী পুর্ণিমা দেবী

(বাম দিক থেকে) শুভাশিস দত্ত পরিবারের নবীন প্রজন্ম, মাতা সর্বমঙ্গলার বিগ্রহ এবং শুভাশিসের পিতামহী পুর্ণিমা দেবী


ওদের পূর্বপুরুষেরা যেসময় কলকাতায় বসত গড়েছিলেন তখন কলকাতা আদতে শহরই ছিল না। তবে শহর হয়ে ওঠার সমস্ত লক্ষ্মণ ছিল তার। জব চার্ণকের বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে ব্যবসায়ীদের পীঠস্থান। তাই সুদূর যশোর থেকে কলকাতায় এসেছিলেন ওদের পরিবারের কর্তারা। ১৭৫০ নাগাদ। ধু ধু করত মাঠ। সূর্যের আলো নিবলেই শেয়াল ডাকত। মাঝে মধ্যে বাঘের ডাকও শোনা যেত বলে জনশ্রুতি। আর কখনও সখনও তোপ দাগার শব্দ আসত শহরের দক্ষিণ দিক থেকে। চার্ণকী চপল এই শহরে তখন নবাবী আমল। মুর্শিদাবাদ থেকে পার্ক স্ট্রিটে এসে উঠেছেন নবাব মীর কাসেম। সেই সব সময় যখন ফোর্ট উইলিয়াম সংলগ্ন একটি এলাকায় বিশাল ভাগাড় ছিল। জল জঙ্গল আর সেসব সরিয়ে নতুন নতুন করে রাস্তা ঘাট তৈরি হচ্ছিল। এরকম সময় দিকে দিকে ডাকাত পড়ত। রাত বাড়লেই হাড় হিম করা নৈশব্দ ভেদ করে ঝি ঝি পোকা ডাকত। পটল ডাঙার দত্তবাড়িতেও ডাকাত পড়েছিল একবার। সেযুগের হা রে রে রে করা ডাকাত সব। কানে তাঁদের গোজা জবার ফুল। মা কালীর আরাধনা করে ধর্মের দোহাই দিয়ে ডাকাতি করাই ছিল স্থানীয় বীর পুঙ্গবদের আদত স্বভাব। এতে দোষ দেখা মানে মায়ের পুজোয় বাধা দেওয়া। বলী অনিবার্য। শোনা যায় ডাকাতিকে আরও বেশি বেশি ধর্মীয় করে তুলতে আরাধ্যা মা কালী সঙ্গে করে নিয়ে আসত ডাকত দল। তেমনি এক ডাকাত হামলা করেছিল দত্ত বাড়ির দালানে। কিন্তু দত্তদের লেঠেল বাহিনীর কাছে কাবু হয়ে পালিয়ে বাঁচে সেই ডাকাতেরা। আর পুকুর পাড়ে ফেলে রেখে যায় তাদের আরাধ্যা দেবীকে। পরে শোনা যায় ডাকাত কালী নাকি দত্ত বাড়ির কোনও এক কর্তাকে স্বপ্নে আদেশ করেন তাঁকে উদ্ধার করার কথা। তুলে এনে পুজো করার কথা। সেই থেকে মাতা সর্বমঙ্গলার পুজো চলে আসছে দত্ত পরিবারে। এখন কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে দত্তদের শরিকিরা। কালী পুজোয় সবাই এক হন। এবার মহেন্দ্র দত্তের পরিবার সেই পুজোর পালা পেয়েছিল। সেই সুবাদে জানা গেল ওদের পরিবারের অতীত ইতিহাস। জানা গেল প্রেরণা দায়িনী রাধারানী দেবীর কথাও।

image


বাংলার ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে বসলেই অধিকাংশ তথাকথিত প্রাজ্ঞজনের নজরে কেবল ঘোরা ফেরা করেন শ্রী অরবিন্দ, চিত্তরঞ্জন দাশ, অথবা আশুতোষ মুখার্জির মত রাজনৈতিক চরিত্রগুলো। কিংবা রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর মশাইয়ের মত সমাজ সংস্কারকদের কথা বলেন কেউ কেউ। সাহিত্যের আলোচনা হলে উঠে আসেন মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল কিংবা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। সব ঠিকই আছে। কিন্তু ইতিহাস তো একচোখো বিষয় নয়। বাংলার সুবর্ণ যুগের ইতিহাসে যাদের উপস্থিতি নিয়ে কেউ কখনও কথা বলেন না অথচ আজও যাদের নিয়ে বাঙালি গর্ব বোধ করে তাদের একজন যেমন ডক্টর বর্মণ, যার নামে ডাবর কোম্পানি ঠিক তেমনি এই মহেন্দ্র দত্ত। আজও সমান জনপ্রিয়, সমান সম্মানিত। বিখ্যাত এই ছাতা নির্মাতার কথা অবশ্য আপনি বাঙালির বাজার লব্ধ চরিতাভিধানে পাবেন না। গুগলে খুঁজতে গেলে উঠে আসবেন প্রকাশক মহেন্দ্র দত্তের কথা, কিংবা বিপ্লবী মহেন্দ্র দত্তের নাটকীয় কর্মসূচি, আর পাবেন স্বামী বিবেকানন্দের ভাই মহেন্দ্র দত্তের উল্লেখ। কিন্তু ছাতা নির্মাতা মহেন্দ্র দত্ত খুঁজলে আপনার সামনে ভেসে উঠবে গুগল ম্যাপ। কলকাতার মহাত্মা গান্ধী রোডের দোকান শোরুমের অনেক ঠিকানা আর কোন দোকানে কী কী ধরণের ছাতা পাওয়া যায় তার লম্বা ফিরিস্তি। আজ থেকে ১৩৫ বছর আগে ঠিক এই স্বপ্নই দেখেছিলেন খোদ মহেন্দ্র দত্ত।