হাতের কাজে দাঁড়িয়াকে আগলেছেন শৈলেন সরদার

হাতের কাজে দাঁড়িয়াকে আগলেছেন শৈলেন সরদার

Friday February 12, 2016,

3 min Read

দাঁড়িয়া। নামের মতোই একসময় ছিল জনপদের চরিত্র। এক্কেবার দাঁড়িয়ে। নিশ্চ‌ল। হয় চাষবাস, খুব বেশি হলে কলকাতায় গিয়ে রাজমিস্ত্রি বা মজুরের কাজ। ছন্দহীন জীবনে বছর কয়েক আগে ঝাঁকুনিটা দিয়েছিলেন শৈলেন সরদার। প্রত্যন্ত এলাকার ছেলেমেয়েদের হাতের কাজ শিখিয়েছিলেন। কাজ বলতে বিভিন্ন রকম ফলের দানা ও নানারকম সামগ্রী দিয়ে গয়না বানানো। আনকোড়া হাতগুলোই এখন মণি-মুক্তো ছড়াচ্ছে। যার ছটায় অভাবের অন্ধকার কবেই পালিয়েছে। অন্যরাও সম্ভ্রমের চোখে দেখছে।

image


ক্যানিং থেকে বারুইপুর যাওয়ার রাস্তার মধ্যবর্তী জায়গা। বাস স্টপেজের নাম বেলেগাছি। সেখান থেকে ভাঙাচোরা পথে ঘণ্টাখানেক উজিয়ে দাঁড়িয়া গ্রামে পৌঁছাতে হয়। পিছিয়ে পড়া এলাকার সব বৈশিষ্ট্যই দাঁড়িয়ার সঙ্গে জড়িয়ে। এমন একটা জনপদে কর্মসংস্থান বলতে ওই দিনমজুরি, না হলে কলকাতায় বাবুদের বাড়ি কাজ, কিংবা কলকাতার দক্ষিণ শহরতলির ফ্ল্যাটের মিস্ত্রি, জোগাড়ের কাজে নাম লেখানো। গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসাননি দাঁড়িয়া বাজারের শৈলেন সরদার। আর্থিক কারণে পড়াশোনা বেশি দূর করতে না পারলেও তাঁর দৃষ্টি ছিল অনেক দূরে। বেলুড়ে হস্তশিল্পের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। সেই বিদ্যে বাড়িতে এসে প্রয়োগ করতে গিয়ে হল বিপত্তি। অনেকেই তাঁকে বলেছিলেন, এসব করে আর কী হবে। অগত্যা স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে ও প্রতিবেশী জলধর সাঁফুইকে নিয়ে কাজ শুরু হল। গাঁয়ে-গঞ্জে যেসব ফলের দানা পাওয়া যায় তা জোগাড় হল। আর বাজার থেকে কেনা হল নানারকম সুতো। এভাবেই তৈরি হতে থাকল মহিলাদের গলার হার, কানের সেট আরও কত কী।

মুষ্টিমেয়র সৃষ্টি নজর এড়ায়নি এলাকার বাসিন্দাদের। তারাও হাতের কাজে আনন্দ খুঁজে পেলেন। তৈরি হল অন্নপূর্ণা গোষ্ঠী। ১০জনের দলের কাজ দেখে প্রশাসনও তাদের পাশে দাঁড়াল। বিভিন্ন মেলা, প্রদর্শনীতে যাওয়ার ছাড়পত্র মিলল। এরপর শৈলেনবাবুদের দেখে কে। মাস দুয়েক আগে বজবজে জেলা হস্তশিল্প মেলা ও করুণাময়ীতে সবলা মেলায় ২৫ হাজার টাকার গয়না নিয়ে গিয়েছিল অন্নপূর্ণা গোষ্ঠী। বিক্রি শুনলে চমকে যাবেন। শৈলেন সরদারের দাবি, এই দুটি মেলা মিলিয়ে প্রায় এক লাখ টাকার বিক্রি হয়েছে। এখানেই শেষ নয়। রাজ্যের মেলা পেরিয়ে ভিনরাজ্যে গিয়ে আরও ভাল অভিজ্ঞতা তাদের। দুটি মেলা সেরে শৈলেনবাবুর দল গিয়েছিল মুম্বইতে। সেখানে মাত্র ১৫ হাজার টাকার জিনিস নিয়ে গিয়ে ৮৫ হাজার টাকা ঘরে এনেছে অন্নপূর্ণা গোষ্ঠী। গোষ্ঠীর সম্পাদক দেবী হালদারের কথায়, ‘‘আমাদের অলঙ্কারের এতটাই চাহিদা যে করে উঠতে পারি না। একটা মেলা শেষ করতে করতে আরও একটা মেলার মালপত্র বানাতে হিমশিম খাই।’’

আগে ছিল পার্টটাইম। মেলার পর থেকে ফুলটাইম। মেয়েদের দম ফেলার সুযোগ নেই। এই ব্যাপারটা দারুণ উপভোগ করেন শৈলেনবাবু। বছর চল্লিশের মানুষটি জানেন কাজই ধর্ম। মান ধরে রাখতে হয়। সেজন্য ফাইবার, রুদ্রাক্ষ, রাজমা, চন্দনের মতো দানাগুলো যখন সংগ্রহ করেন তখন প্রতিটি দেখে নেন। এখন মেলা, প্রদর্শনী আছে। বাকি সময় কী করবেন? চকিতে শৈলেনবাবুর উত্তর, "বাড়িতে দোকান ভালভাবে চালাব। বড়বাজারের অর্ডারগুলো ধরতে হবে।" কাজের ফাঁকে তিনি জানালেন এবার নাগপুরে যেতে হবে। ওখানে এইসব জিনিস খুব ভাল চলে। গ্রামের মেয়েরা জানো ঠিকমতো কাজ করলে দিনে ৫০০ টাকা রোজগার করা কোনও ব্যাপারই নয়। উপার্জনের টাকায় তাদের স্বাচ্ছন্দ্যও এসেছে। দাঁড়িয়ার মনবদলের পিছনে থাকা মানুষটি অবশ্য এত তাড়াতাড়ি খুশি হবার পাত্র নন। তিনি চান আরও মেয়েরা আসুক এর ছাতায়। তারাও বুঝুক জীবনের মানে।

image