পুরুলিয়ায় বদল আনছে Tata, Google এর ইন্টারনেট 'বান্ধবী'

পুরুলিয়ায় বদল আনছে Tata, Google এর ইন্টারনেট 'বান্ধবী'

Wednesday June 08, 2016,

4 min Read

গীতা মাণ্ডি। বান্দোয়ানের মেয়ে। ক্লাস এইট পাস। অল্পবয়সেই বাড়ি থেকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। পড়াশুনো আর এগোয়নি। তবুও ও এখন গ্রামের সব থেকে জ্ঞানী মানুষ। ওর কাছে গোটা গ্রাম আছড়ে পড়ে। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে... সামান্য কোনও জিনিস নিয়ে খটকা হলেই গীতার বাড়ি দৌড়য় গ্রামের মানুষ। কারণ ওঁর কাছে একটা স্মার্টফোন আছে। তাতে আছে ইন্টারনেট।

কিছুদিন আগেও ইন্টারনেট কী বস্তু তাই জানতেন না গীতা। ওঁকে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে শিখিয়েছে খোদ Google। ওঁর পাশে রয়েছে Tata Trust-এর মত সংস্থা। হাসিমুখে সবার সব আবদার তাই সামলান মেয়েটি। বলছিলেন সেই গল্প। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিল ওবেরয় গ্র্যান্ডের বিশাল হলরুম ঠাসা জনতা। বলছিলেন, একবার এক ভদ্রমহিলা এসেছিলেন ওর কাছে। মরণ বাঁচন সমস্যা নিয়ে। দশ মাসের অন্তঃসত্ত্বা মেয়ের জীবন নিয়ে টানাটানি... স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্র জবাব দিয়ে দিয়েছে। এবার কী করণীয়। অনেকে অনেক কথা বলছে। কিন্তু ওই মহিলা ছুটে এসেছেন ইন্টারনেট দিদির কাছে। শুধু জানতে, কোথায় নিয়ে গেলে প্রাণে বাঁচবে মেয়ে। ঠাণ্ডা মাথায় গুগল সার্চ করে সেযাত্রায় উতরে দিয়েছিলেন গীতা। এরকম ভুঁড়ি ভুঁড়ি গল্প আছে গীতার ঝুলিতে। 

গীতা একা নন, এরকম আরও অনেক গীতাই আছেন পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে। যেমন কুনামি মাণ্ডি মুর্মু, ছটুমণি কারদিপ এঁরা সকলেই টাটা ট্রাস্ট এবং গুগলের যৌথ সামাজিক উদ্যোগ ইন্টারনেট সাথির সদস্য। এই প্রকল্পে যুক্ত হওয়ার আগে এঁদের কেউই কস্মিনকালেও ইন্টারনেট কী বস্তু জানতেন না। এখন রীতিমত সকলকে ইন্টারনেট খুলে, গুগল সার্চ করে পরামর্শ দেন। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সঙ্গে কাজ করেন ওঁরা। সাইকেলে চেপে গ্রামের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ঘুরপাক খান। দূর থেকে বাচ্চারা বলে আইসক্রিম দিদি এসে গেছে। তারপর নানান আবদার... কারও টমেটো চাষে কী সার নতুন উঠেছে, বাজারে কোন বীজ ভালো? শুধু কি তাই, বিনি পয়সায় মথুরা বৃন্দাবন ঘুরিয়ে আনার আবদারও রাখতে হয়। মোবাইলের ছোট্ট স্ক্রিনে যখন ফুটে ওঠে ছবি গোটা পাড়া কাঁপিয়ে হাততালি পড়ে।

দেশের পিছিয়ে পড়া অঞ্চলগুলির মধ্যে এই রাজ্যের পুরুলিয়া জেলাই সব থেকে বেশি জ্বলজ্বল করছে। তাই টাটা ট্রাস্ট এবং গুগল পুরুলিয়াকেই বেঁছে নিয়েছে এই রাজ্যে প্রকল্প শুরু করার আদর্শ জায়গা হিসেবে। Google এর 'Helping Women Get Online' নামে যে প্রকল্প আছে তারই অংশ এই 'ইন্টারনেট সাথী' প্রকল্প। গ্রামে-গঞ্জে মেয়েদের মধ্যে ইন্টারনেট নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যেই বছর খানেক আগে এই উদ্যোগ নিয়েছিল গুগল। টাটা ট্রাস্ট এর মতো সমাজসেবায় ব্রতী সংস্থাকেও পাশে পেয়ে গিয়েছে এই বহুজাতিক সংস্থা। যৌথ উদ্যোগে এই সাথীদের প্রশিক্ষণের কাজ শুরু হয়েছে গতবছর জুলাই মাসে। এর আগে রাজস্থান, গুজরাট, ঝাড়খণ্ড অন্ধ্রপ্রদেশ এবং মধ্যপ্রদেশে প্রকল্পটি আসে। ইতিমধ্যেই লাখ দুয়েক মহিলা এই উদ্যোগে সরাসরি উপকৃত হয়েছেন।

এরাজ্যে এই প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে বলতে গিয়ে গুগল ইন্ডিয়ার মার্কেটিংয়ের প্রধান স্বপ্না চাড্ডা বলেন, পুরুলিয়ার চারশোটি গ্রামে পৌঁছতে চান ওঁরা। আপাতত ১২০ জন ইন্টারনেট বন্ধু তৈরি করার কাজ চলছে। তারাই পৌঁছবেন এই চারশো গ্রামে। ঘুরে ঘুরে সরকারি স্কিমগুলি বোঝাবেন গ্রামের মানুষকে। ডিজিটাল ইন্ডিয়ার সাথে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করবে গুগল-টাটা ট্রাস্ট। এই ১২০ জনই গ্রামের অন্য মহিলাদের শেখাবেন ইন্টারনেট ব্যবহারের উপকারিতা। ইতিমধ্যেই দারুণ সাড়া পড়েছে পুরুলিয়ায়। পুরুলিয়ার পর অন্য জেলাতেও ছড়িয়ে যাবে এই উদ্যোগ। অন্তত ১ লক্ষ মহিলাকে ইন্টারনেট স্বাক্ষর করতে চান ওঁরা। টাটা ট্রাস্টের উদ্ভাবন বিভাগের প্রধান গণেশ নীলম বলছেন, স্থানীয় ভাষাতেই শেখানো হচ্ছে ইন্টারনেট ব্যবহার করার উপায়, বিভিন্ন মডিউলের মারফত। ল্যাপটপ কম্পিউটারের থেকেও বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে মোবাইল ইন্টারনেটকে। ইন্টারনেট পেনেট্রেশন কম যেমন সত্যি তেমনি এই প্রকল্পে অনেকগুলো বাধাও আছে। যেমন প্রত্যন্ত গ্রামে অনেকক্ষেত্রেই মোবাইলের টাওয়ার পাওয়া যায় না, ইন্টারনেটের স্পিড ভীষণই কম। ফলে গ্রামের মানুষের কাছে ইন্টারনেট পৌঁছে দেওয়ার স্বপ্ন কোথায় একটা হোঁচট খাচ্ছে, সেকথাও অকপটে স্বীকার করে নিয়েছেন গণেশ। এবিষয়ে বেশকিছু টেলিকম সংস্থার সঙ্গে ওদের কথা চলছে। পুরুলিয়ার মত গ্রামে টাটা ট্রাস্ট দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে সেই সুবাদে ওই জেলার নাড়িনক্ষত্র ওরা জানেন। তবুও সমস্যাগুলো যখন যেমন এগিয়ে আসছে তখন তেমন ভাবে তা মোকাবিলা করতে চাইছে টাটা ট্রাস্ট। এই প্রকল্পের যাত্রাপথটাই ওদের কাছেও একটা দারুণ শিক্ষা বলছিলেন গণেশ নীলম।

আরও নটি রাজ্যে এই প্রকল্প চালু হবে বলে জানালেন তিনি। তার মধ্যে ত্রিপুরা, উত্তরপ্রদেশ এবং আসাম রয়েছে। প্রাথমিক ভাবে 'ইন্টারনেট বন্ধু' যারা হবেন তারা প্রাথমিকভাবে হাজার টাকা মাস মাইনেতে কাজ করবেন। কিন্তু ভবিষ্যতে এই মাসোয়ারা বন্ধ করে ইন্টারনেট বন্ধুদের স্বনির্ভর হতেই শেখানো হবে বলে জানিয়েছেন গণেশ এবং স্বপ্না।