জীবনে লড়াই অনেকেই করেন। কিন্তু সাফল্য পেতে হলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। নিরক্ষর লরি চালকের ছেলের উচ্চশিক্ষিত হওয়ার মধ্যে চমক নাও থাকতে পারে। কিন্তু নরেশের গল্পটা একদম আলাদা।
মাদ্রাজ আই আই টির তুখোড় ইঞ্জিনিয়ার নাগা নরেশ কারুতারা জন্মেছেন অন্ধ্রপ্রদেশের গোদাবরীর তীরের তিপারু গ্রামে। ছোটো বেলা থেকেই পড়াশুনোয় ভালোই ছিলেন নরেশ। পরিবারে প্রথম সাক্ষর। আর তাও ক্লাসের সেরা ছেলে। একবার এক ছুটির দিনে, সম্ভবত কোনও এক সংক্রান্তির ছুটিতে খেলতে খেলতে একটা লরিতে উঠেছিলেন নরেশ। পাশেই বাবার লরি। আচমকাই লরি থেকে পড়ে যান। গুরুতর চোট পান পায়ে। তাকে সকলে ধরাধরি করে সামনের বেসরকারি নার্সিংহোমে নিয়ে যায়। কিন্তু শুধুমাত্র গরিবের ছেলে বলে তাকে ভর্তিই নেয়নি সেই নার্সিং হোম। লোক দেখানো প্রাথমিক চিকিৎসা করেই হাত গুটিয়ে নেয়। ১৯৯৩ সালের সেই সংক্রান্তির রাতটা কোনোদিন ভুলবেন না নরেশ। সেই প্রত্যাখ্যান আজও তাঁর মগজে চাবুক মারে। এক স্থানীয় কনস্টেবল সদয় হয়ে তাকে সরকারি একটি হাসপাতালে ভর্তি করান। কিন্তু ততক্ষণে অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছিল। পা দুটোই বাদ দিতে বাধ্য হন চিকিৎসকরা। নরেশ ছেলেবেলা থেকেই তাই হুইল চেয়ারে। তাবলে পিছিয়ে পড়েননি। নিজেকে প্রতিবন্ধী ভেবে হীনমন্যতায় ভোগেননি। নরেশ বলেন তাঁর পা হারানো জীবনের মোড় নাটকীয় ভাবে ঘুরিয়ে দেয়নি। আর পাঁচটা ছেলের মতোই শৈশব উপভোগ করেছেন। সুস্থ স্বাভাবিক শিশুদের মতোই বড় হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছেন। জীবনের চলার পথে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাওয়া প্রত্যাখ্যানগুলো জমিয়ে রেখেছেন। আর নিজের শিক্ষা দিয়ে প্রত্যাখ্যানকেই প্রত্যাখ্যান করেছেন নরেশ।
লেখাপড়ায় তুখোড় হওয়া সত্ত্বেও নরেশের পড়া থমকে গিয়েছিল শুধু দারিদ্রের কারণে। গরিব বাবা-মা আর হুইল চেয়ার বসে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন-দেখা নরেশ ঘুরতে ঘুরতে তানুকু নামের একটি শহরতলী এলাকায় চলে আসেন। পড়াশুনো আবার শুরু করাতে নরেশকে একটি মিশনারি স্কুলে ভর্তি করা হয়। দেখতে দেখতে এই স্কুলে অনেক বন্ধু পায় নরেশ। রাস্তাটা খোলে। তিনি আইআইটির জয়েন্ট এন্ট্রান্সে ৯৯২ পজিশন পান। বিকলাঙ্গ ক্যাটাগরিতে চতুর্থ হন।
"পৃথিবীটা ভালো মানুষে ভরা "
মাদ্রাজের IIT তে অনেক চমক নরেশের অপেক্ষায় ছিল। ট্রেনে সুন্দরের সঙ্গে আলাপ। তিনি নরেশের হস্টেলের সব খরচ চালানোর দায়িত্ব নেন। ছেলেবেলার সেই সরকারি হাসপাতাল তাঁর কলেজের খরচ দিতে এগিয়ে আসে। নরেশের চলাফেরার সুবিধা করে দিতে ডিপার্টমেন্টের বন্ধুরা লিফ্ট আর ঢালু ধাপের ব্যবস্থা করে। ডিন ইডিচান্দি এবং ছাত্রদের জেনারেল সেক্রেটারি প্রসাদ তাঁকে একটা আধুনিক মানের হুইল চেয়ার কিনে দেন। নরেশ হেসে বলেন,"পৃথিবীটা আসলে ভালো মানুষেই ভরা।"
চিরকাল আশাবাদী নরেশ। কম্পিউটার সায়েন্স ইঞ্জিনিয়ার নরেশকে পেতে Morgan Stanley এবং Google সাদরে ডাকছে। computer science, algorithms আর game theory নিয়েই কাজ করতে চান নরেশ। আরও পড়তে চান। তবু এখন গুগুলের ডাকেই সাড়া দিলেন। আর কোনও প্রত্যাখ্যান নয়। এখন ওঁর জন্য সকলেই গর্বিত। আপনি কি অস্ফুটে আহা (!) বলে উঠলেন, নরেশ শুনতে পেলে খুব দুঃখ পাবে। কারণ ও কারও করুণা চায় না। নিজের মেরুদণ্ডে ভর দিয়ে আরও মজবুত হয়ে দাঁড়াতে চায়।