কেরলের 'চাষার ব্যাটা' সিঙ্গাপুরে কোটিপতি

কেরলের কোল্লার জেলার দরিদ্র কৃষক পরিবারের ছেলে বরুণ চন্দ্রন। এখন তার সংস্থা চারটি মহাদেশ জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সাফল্যের সিঁড়ি পেরোনোর সুলুক দিলেন সিঙ্গাপুরের এই কোটিপতি তরুণ।

কেরলের 'চাষার ব্যাটা' সিঙ্গাপুরে কোটিপতি

Monday August 24, 2015,

6 min Read

জীবনের পাঠশালাই সবচেয়ে বড় শিক্ষক। আর বেঁচে থাকার তাগিদই সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। বরুণ চন্দ্রনের জীবনের দিকে তাকালে সেকথাই স্পষ্ট হয়।

বরুণ চন্দ্রন

বরুণ চন্দ্রন


কেরলের কোল্লার জেলার ছোট্ট একটি গ্রাম পদম। জঙ্গলে ঘেরা সেই গ্রাম থেকেই বরুণের উঠে আসা। প্রায় না খেতে পাওয়া অবস্থা থেকে বিশ্বের দরবারে বরুণ এখন সগর্বে উপস্থিত। সিঙ্গাপুর থেকে একটি সংস্থা চালাচ্ছেন। যে সংস্থা ডালপালা মেলেছে বিশ্বের বহু প্রান্তে। এও কি সম্ভব? উত্তরটা বরুণ নিজেই। উদাহরণ হয়েছেন হাজার-হাজার মানুষের।

"আমার কৃষক বাবা ছেলেবেলা থেকেই শিখিয়েছেন কঠোর পরিশ্রম করতে। রোজ তাঁকে যতটা পারতাম সাহায্য করতাম। আমাদের ঠিকমতো খাওয়াও জুটত না। অতি সামান্যে সংসার চলত। আমার শৈশব বলতে আসলে শুধুই বেঁচে থাকার লড়াই। আর সেটাই ছিল আমার চালিকাশক্তি। আমাকে বড় হতেই হবে। শিখলাম শ্রমের মর্যাদা", বললেন কর্পোরেট 360 -র ( কর্পোরেট থ্রি সিক্সটি) প্রতিষ্ঠাতা বছর বত্রিশের বরুণ। চারটি মহাদেশে আজ কাজকর্ম চালাচ্ছে বরুণের এই সংস্থা।

দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মালেও কিছু করে দেখানোর জেদ ছিল এই তরুণের। বাবা-মা ক্লাস ফাইভের গণ্ডি পেরননি। কিন্তু চেয়েছিলেন ছেলে পড়াশোনাটা শিখুক। গ্রামের কাছেই পাথানাপুরামে একটি স্কুলে ভর্তি হন বরুণ।পড়াশোনার থেকেও সেখানে ফুটবলে বেশি নজর কাড়তে শুরু করলেন তিনি। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর স্কুল সেন্ট থমাসকে গর্বিত করতেও শুরু করলেন। গলায় উঠতে লাগল একের পর এক পুরস্কার আর মেডেল।

ফুটবলের সৌজন্যে ক্লাস টেনের পড়া শেষ করতেই কেরল সরকারের সৌজন্যে পেলেন স্কলারশিপ। যে স্কলারশিপের টাকাটা না পেলে বরুণের হয়তো লেখাপড়ায় সেখানেই থেমে যেত। ফুটবলে নিজেকে মেলে ধরতে বরুণও চেষ্টার কসুর করলেন না। পেতে থাকলেন একের পর এক স্বীকৃতিও। কেরলের সেরা যুব ফুটবলারের সোনার মেডেল উঠল বরুণের গলায়। কেরল যুব দল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনায়কত্বও করেন বরুণ।


সরকারি সম্মান নিচ্ছেন বরুণ

সরকারি সম্মান নিচ্ছেন বরুণ


কিন্তু সেই খেলার মাঠেই একবার এমন চোট পান যে ছেড়েই দিতে হয় ফুটবল। ছাড়লেন কলেজও। একটা কাজের খোঁজে চলে এলেন বেঙ্গালুরু।

বরুণের কথায়, "পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর একটা চাপ প্রয়োজনীয়তা ছিল। আমাকে তাঁর সোনার বালা জোড়া তুলে দিয়েছিলেন ঠাকুমা। বলেছিলেন, ওগুলো বিক্রি করে অন্য কোথাও নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে। আমিও ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ি ছাড়লাম।" আজও এসব কথা ভুলতে পারেন না বরুণ। একটা ব্যাগে সামান্য কিছু সম্বল আর অতি ক্ষীণ একটা আশা নিয়ে একদিন বরুণ পা রাখলেন বেঙ্গালুরুতে। তথ্যপ্রযু্‌ক্তি নিয়ে বরুণের তেমন কোনও ধারণাই ছিল না। কিন্তু তা কোনও বাধা হল না। তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে যতটা সম্ভব শিখতে শুরু করলেন।ইন্টারনেট কাফেতে বসেই শুরু হল বরুণের শেখার পালা। শুধুমাত্র আইটি নিয়ে জানার আগ্রহই বরুণকে তাড়িয়ে নিয়ে গেল। বরুণও বুঝলেন কিছু করতে গেলে ইংরেজি জানাটা জরুরি। কিনে ফেললেন একটা ডিক্সনারি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাতে লাগলেন পাবলিক লাইব্রেরিতে। সে সময় সিডনি শেলডন আর জেফ্রি আর্চারের নভেলে বুঁদ হয়ে থাকতেন বরুণ। দেখতে লাগলেন সর্বভারতীয় ইংরেজি নিউজ চ্যানেলগুলি। এসবই শুধুমাত্র ইংরেজি ভাষাটা রপ্ত করার জন্য।

সরাসরি না হলেও বরুণ অবশ্য অনুপ্রেরণা পাচ্ছিলেন আর একজনের থেকেও।তিনি একজন ফুটবলার।বরুণ বললেন, "স্কুলে থাকার সময় থেকেই ফুটবলার আই এম বিজয়ন আমার অনুপ্রেরণা ছিল।আমার কাছে বিজয়ন মানে ভগবানের মতো। রাস্তায় কাটিয়ে, সোডা আর বাদামভাজা বিক্রি করেও একসময় ভারতের অন্যতম সেরা ফুটবলার হয়েছিলেন বিজয়ন।আমি সবসময় ভাবতাম, এত প্রতিকূলতার মধ্যে থেকেও বিজয়ন যদি এত বড় হতে পারে, আমিও পারব।" বেঙ্গালুরুর সাইবার কাফেতে কাজ করতে করতেই ইন্টারনেট বেশ ভালোই রপ্ত করে ফেললেন বরুণ।কিন্ত সেটুকু যথেষ্ট নয়। শুরু হল একজন দক্ষ প্রোগ্রামার হওয়ার প্রাণপাত চেষ্টা।বরুণ বলেন, "আমি বিশ্বাস করি কোনও কিছুই অসম্ভব নয়।এখন ইন্টারনেটে এতকিছু জানতে পারা যায় যে আপনি অনেক কিছুই শিখে ফেলতে পারেন।আমরা যদি কিছু শিখতে চাই, সবকিছুই হাতের নাগালে রয়েছে।"


বরুণের গ্রাম কেরলের পদম

বরুণের গ্রাম কেরলের পদম


বেঙ্গালুরুতে এভাবেই কয়েক বছর কাজ করার পরে একদিন কাজের প্রস্তাব এল সিঙ্গাপুর থেকে। সেটা ২০০৮ সাল। কাজের সুযোগের ক্ষেত্রে বরুণের চোখ খুলে দিল সিঙ্গাপুর।ছোট থেকে বড়, হরেক রকম কাজ।এই সুযোগকে কীভাবে কাজে লাগান যায় তারই প্রস্তুতি শুরু করে দেন বরুণ।কাজ করতে করতেই, নিজের কাজকে কীভাবে আরও সহজ করে তোলা যায় তার জন্য সফটওয়্যার কোডিংয়ের একটা উপায় খুঁজতে থাকেন বরুণ। সাড়াও মিলল। সহকর্মীরা তাঁর এই কাজের প্রশংসা করলেন।বরুণের জন্য খুলে গেল নতুন একটা দরজা। জন্ম নিল বরুণের সংস্থা কর্পোরেট থ্রি সিক্সটি।"আমি দেখতাম লোকজন সবসময় বিগ ডেটার কথা বলছে।আমিও নিজেকে প্রশ্ন করতাম, এই এতসব তথ্য কীভাবে নেটে নিয়ে আসা যায়, যাতে কোম্পানিগুলোর ব্যবসা ও বিক্রি বাড়ে",বললেন বরুণ।

তথ্যপ্রযু্ক্তি সংস্থাগুলোর জন্য বরুণের সি থ্রি সিক্সটি নিয়ে এল অভিনব এক সেলস ইনটেলিজেন্স সফটওয়্যার।এরই সুবাদে বিশ্বের বেশ কয়েকটি নামি আইটি সংস্থা এবং আইটি স্টার্টআপস এখন বরুণের ক্লায়েন্ট।বরুণের কথায়, "মার্কেটিংয়ের জন্য অধিকাংশ কোম্পানি বিগ ডেটা ও প্রেডিকটিভ আনালেটিকসের কথা বলে। কিন্তু সেগুলো এই ইন্ডাস্ট্রির কাজের ক্ষেত্রে ততটা উপযোগী নয়।এর আলগারিদমটা এমন ভাবে ভাবা হয়েছে যা জেনেরিক ডেটা ইন্ডিকেটর হিসাবে কাজ করে। কিন্তু আমরা কাস্টমারদের জন্য নিয়ে এলাম বিপণনের এমন একটা উপায়, যা সম্ভাব্য ক্রেতার কাছে সঠিক সময়ে সঠিক বার্তাটা পৌঁছে দিতে পারে।যা জোরদার করতে পারে সেলস ক্যাম্পেনটাকেই", জানালেন বরুণ।এমনই একটা ক্লাউড সফটওয়্যার টেক সেলস ক্লাউড, যা বরুণের সংস্থার ফ্ল্যাগশিপ প্রোডাক্ট।এর ডিজাইনটাই করা হয়েছে আইটি মার্কেটিয়ারদের চাহিদাকে মাথায় রেখে।যাতে তারা মার্কেটিং ক্যাম্পেনটা আরও ছড়িয়ে দিতে পারেন। টেক সেলস ক্লাউডের চালিকাশক্তি হিসাবে পিছনে রয়েছে বিগ ডেটা,প্যাটানর্স, প্রেডিকটিভ আনালেটিকস, কম্পিটিটিভ ইনটেলিজেন্স, কন্ট্রাক্টস ইনটেলিজেন্স, ওয়েব আনালিসিস এবং অবশ্যই আইটি রিসার্চ।

বিষয়টাকে আরও সহজভাবে ব্যাখ্যা করেছেন বরুণ। তাঁর কথায়, কাস্টমার রিলেশনস ম্যানেজমেন্ট (সিআরএম) এবং মার্কেটিংয়ের জন্য প্রচুর টাকা খরচ করে থাকে কোম্পানিগুলো। কিন্তু কাজটা তখনই ঠিক ভাবে হবে যখন সঠিক তথ্যভাণ্ডার হাতে থাকবে। আমাদের সেলস ক্লাউড ডেটা প্ল্যাটফর্ম সেই সুযোগটাই করে দিচ্ছে সংস্থাগুলির মার্কেটিংয়ের ক্ষেত্রে। যাতে তারা যে টাকাটা খরচ করছেন, তার থেকে বেশি টাকা ঘরে আসে। সোজা কথায় ম্যাক্সিমাম রিটার্ন অব ইনভেস্টমেন্ট। আমরা লক্ষ্য করেছিলাম, টার্গেট বেসে সবসময় পরিবর্তনের ফলে আইটি মার্কেটিয়াররা বিপাকে পড়ে যাচ্ছেন। এবং তাঁদের মার্কেটিং বাজেটের একটা বড় অংশ এমন কিছুর জন্য খরচ হচ্ছে যার থেকে কোনও রিটার্ন মিলছে না। আমরা এই সমস্যাটার সমাধান করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আইটি মার্কেটিয়ারদের জন্য নিয়ে এলাম ডেটা আস এ সার্ভিস। এমন কনসেপ্ট এই প্রথম। আমাদের এই কনসেপ্ট একটা নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে যে কেউই ব্যবহার করতে পারেন। মিলবে রিয়াল টাইম ডেটা রিফ্রেশ। মিলবে ডেটা মেইনটিন্যান্স সহায়তাও।

দু-বছরের সংস্থাটি সম্প্রতি ছুঁয়ে ফেলেছে মিলিয়ন ডলারকে। সামনে আরও বড় পরিকল্পনা। ২০১৫-র মধ্যেই লাভের লক্ষ্যমাত্রা রাখা হয়েছে পাঁচ মিলিয়ন ডলার। নেওয়া হবে আরও কর্মী। ইউরোপ ও আমেরিকায় নতুন অফিস খোলা হবে। অবস্থা এমনই দাড়িয়েছে যে বরুণের সংস্থাকে কিনে নিতে চেয়েছে আইটি ক্ষেত্রের বেশ কয়েকটি সংস্থা। কিন্তু লোভনীয় সেইসব প্রস্তাব খারিজ করে দিয়েছেন বরুণ। যে স্বপ্ন নিয়ে তাঁরা রয়েছেন তাকেই আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে চান তাঁরা।


বরুণের সহকর্মীরা

বরুণের সহকর্মীরা


সাফল্যের মধ্যেও বরুণ কিন্তু তাঁর শিকড়কে ভুলে যাননি। কেরলের সেই পাথানাপুরমেও একটি অফিস খুলেছেন। বরুণ চান তাঁর বেড়ে ওঠার জায়গাতেও কাজের সুযোগ তৈরি হোক। আরও এটাও বুঝেছেন, প্রতিভার অভাব নেই, ঘাটতি যেটা রয়েছে সেটা সুযোগের। সুযোগ পেয়ে তাঁরাও তাঁর মতোই উঠে আসুক। বরুণ ঠিক তাঁদেরকেই খুঁজে নিতে চান।

জীবনকে নানাভাবে একচক্কর দিয়ে ফেলেছেন আজকের এই বরুণ। সাফল্য তাঁর কাছে ধরা দিয়েছে। বরুণ বলছেন, উদ্যম আর অধ্যবসায় থাকলে সবকিছুই সম্ভব। তবে শেখাটা কখনই শেষ হয়ে যায় না। ইতিবাচক মানসিকতা বজায় রেখে প্রতিদিনই শিখতে হবে।