উদ্ভাবনী ভাবনাই এগিয়ে চলার চাবিকাঠি সিওনা কসমেটিকসের

উদ্ভাবনী ভাবনাই এগিয়ে চলার চাবিকাঠি সিওনা কসমেটিকসের

Wednesday November 18, 2015,

5 min Read

শুরুয়াতি ব্যবসার জগতে আধিপত্য তরুণ সমাজের, তাঁদের উত্সাহ, কর্মক্ষমতা, ঝুঁকি নেওয়ার সাহস,উদ্ভাবনী চিন্তা এই দৌঁড়ে অনেকটাই এগিয়ে রাখে তাঁদের। ভারতীয় স্টার্টআপের ভবিষ্যত্ তরুণদের হাতেই,এমনটাই মত বিশেষজ্ঞদের. তবে কী অভিজ্ঞতা আর পরিণত চিন্তার প্রয়োজনীয়তা নেই শুরুয়াতিতে, সিওনা কসমেটিকসের রাজা ভারাথ্রাজুর সাফল্য কিন্তু অন্য কথা বলছে।

image


কেভিনকেয়ারে (চিক শ্যাম্পু স্যাশেতে বিক্রি করে এফএমজিসি প্যাকেজিংয়ে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনে যে কোম্পানি) চার বছর কাজ করেন রাজু, কোম্পানির চেয়ারম্যান সিকে রঙ্গনাথনের কাছে শেখেন পার্সোনাল কেয়ার মার্কেটের খুঁটিনাটি। এরপর যোগ দেন ফোর্ড ইন্ডিয়ায়, বিশ্বমানের ব্র্যান্ড কীভাবে লঞ্চ হয় সেই শিক্ষা হয় সেখানে, ফিয়েস্টার ১০০ কোটি টাকার লঞ্চিংয়ে নেতৃত্ব দেন রাজা। এরপর তিন বছর হেনকেলস কসমেটিকসে জাতীয় স্তরের মার্কেটিংয়ের কাজ, এবং শেষে চার বছর আইডেন্টিটি ডিজাইনে কাজের অভিজ্ঞতা, এই বিজ্ঞাপন কোম্পানিকে ১০ গুণ বাড়তে সাহায্য করেছিলেন রাজা।

২০১৩ সালে নিজের কোম্পানি সিওনা কসমেটিকস শুরু করার সময় রাজুর ঝুলিতে ছিল এই দীর্ঘ কাজের অভিজ্ঞতা যা তাঁকে বাজার বুঝতে এবং সেই মতো ব্যবসার কৌশল ঠিক করতে সাহায্য করেছিল।

ভারতের প্রসাধন শিল্পের বাজার ৪.৬ ইউএস ডলার, এবং তা প্রতিবছর ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে লোভনীয় হলেও এটি একটি জটিল বাজার। তাই এই বাজারে সাফল্য অর্জনের জন্য প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা ও কৌশল। প্রথমত চুলের যত্ন, ত্বকের যত্ন, রঙিন প্রসাধনী ইত্যাদি নানা ভাগ রয়েছে, এদের প্রত্যেকের আবার কতগুলি নির্দিষ্ট ভাগ রয়েছে এবং প্রতিটি ভাগের নামী ও প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ড রয়েছে, রয়েছে সাধারণের ব্যবহার্য পণ্য। এরপর রয়েছে লিঙ্গ অনুযায়ী পণ্যের ভাগ, সেটি আবার আরও জটিল হয়ে ওঠে যখন দেখা যায় ফেয়ার অ্যান্ড লাভলির মতো মহিলাদের জন্য তৈরি পণ্যের ক্রেতাদের একটা বড় অংশ পুরুষ। ব্র্যান্ড এই শিল্পে সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ, আর বিজ্ঞাপনের খরচ প্রচুর (টিভির বিজ্ঞাপনের এক পঞ্চমাংশ আসে প্রসাধন কোম্পানি থেকে)। এই বাজারের পুরোভাগে রয়েছে ইউনিলিভার, প্রক্টার অ্যান্ড গ্যাম্বল্ ও ল্যরিয়্যলের মতো বিশ্বমানের কোম্পানি। একই কোম্পানির বিভিন্ন ব্র্যান্ড আবার একে অপরের প্রতিযোগী, যেমন ল্যাকমে ও পনডস্ ত্বকের ক্রিমে পরস্পরের প্রতিযোগী, আবার লিপস্টিক ও নেল পলিশের ক্ষেত্রে ল্যাকমের প্রতিযোগী এলে ১৮, এবং এই সব ব্র্যান্ডগুলিরই মালিক ইউনিলিভার।

এই বড় বড় কোম্পানির মধ্যে কী ভাবে টিকে গিয়ে সাফল্য পেল রাজার সিওনা কসমেটিকস? রাজার মতে, ব্যবসায় কৌশলই মূল কথা। “প্রসাধনের ব্যবহারকে তিনটি ভাগে ভাঙা যায়, স্যালন, স্যালন পরবর্তী ও খুচরো বাজার। খুচরো ব্যবসায় সরাসরি ঢোকাটা কঠিন। তাই সিওনার প্রথম লক্ষ্য ছিল স্যালনে প্রয়োজনীয় প্রসাধন সামগ্রী উত্পাদন। এই সমস্ত পণ্য খুবই কার্যকরী, তবে একজন পেশাদার বিউটিশিয়ানই পারেন তা ব্যবহার করতে”। এর পরবর্তী পদক্ষেপ ছিল স্যালন পরবর্তী পণ্য, অর্থাৎ ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য স্যালনে যে সব পণ্য বিক্রি হয় সেই পণ্য উত্পাদন ও বিক্রি।

image


সিওনা যখন ব্যবসা শুরু তখন চুলের যত্নের পণ্যে ল্যরিয়্যলের মতো ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠিত নাম। কিন্তু ত্বকের যত্নের পণ্যের ক্ষেত্রে সুযোগ দেখতে পান রাজা। একদিকে ছিল অত্যধিক দামী বিদেশী পণ্য, যা ব্যবহারে একটি সাধারণ ফেসিয়ালের দাম পড়ে যেত অন্তত পক্ষে ৫০০-৬০০ টাকা, অন্যদিকে ছিল কিছু স্থানীয় পণ্য, যার দাম এক দশমাংশ। এই দুইএর মাঝে একটা বড় জায়গা ফাঁকা ছিল যেটাকে লক্ষ্য করে সিওনা, ব্র্যান্ডেড, উচ্চমানের কিন্তু যার দাম সাধ্যের মধ্যে এমনই পণ্য তৈরি করা ছিল উদ্দেশ্যে। পণ্য সরবরাহের দিক থেকেও এই ক্ষেত্রটি বেছে নেওয়াই ছিল সুবিধেজনক, কারণ এতে খুচরো বিক্রির মতো অত বড় সরবরাহ নেটওয়ার্কের প্রয়োজন নেই। এছাড়াও একটি পণ্য যখন স্যালনে ব্যবহৃত হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই তা ক্রেতাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। তিনরকমের দামের পণ্য তৈরি করে সিওনা যাতে বিভিন্ন মানের স্যালনে পৌঁছনো যায় আবার স্যালনরাও বিভিন্ন দামের পরিষেবা দিতে পারে তাঁর ক্রেতাদের। বাজারে নিজেদের পণ্যের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য আরও একটি কৌশল ঠিক করেন রাজা, ছোট প্যাকেজে (৫০ থেকে ১০০ গ্রাম) জিনিস বিক্রি, বাজারে বেশিরভাগ পণ্যই পাওয়া যাচ্ছিল ০.৫-১ কেজির প্যাকেজে। রাজা বললেন, “বেশি বড় প্যাকেজের জিনিস কিনলে তার একটা বড় অংশ নষ্ট হয়, কারণ পুরোনো হয়ে গেলে তার কার্যকারীতা ও টাটকাভাব নষ্ট হয়ে যায়। ছোট প্যাকেজ তাই সহজেই গ্রহণযোগ্য হয় স্যালনগুলির কাছে”।

প্রসাধনী শিল্পে দুটি বিষয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, প্রসাধণী পণ্যটির প্রস্তুতি ও প্যাকেজিং। রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের জন্য সিওনার শুরুতেই রাজা নিয়ে আসেন বালাজি বালসুভ্রামনিয়মকে, ইউনিলিভার, ইমামির মতো সংস্থায় ২০ বছর পণ্য প্রস্তুত, গুণমান বিচারের কাজের অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর। ভারতীয় ত্বকের জন্য উপযুক্ত বিশ্বমানের পণ্য তৈরিই ছিল উদ্দেশ্য। রাজার মতে, “উদ্ভাবনই সিওনার এগিয়ে চলার মূল চাবিকাঠি,বললেন, একজন যখন কোনও স্যালনে যান তিনি কিছু পূর্বনির্ধারিত প্যাকেজ পান, কিন্তু প্রত্যেকের সমস্যা আলাদা, যেমন কারও কম বয়সে বলিরেখার সমস্যা, তো কেউ শুষ্ক ত্বকের সমস্যা নিয়ে আসেন, তাই আমরা কাস্টমাইসড পণ্য তৈরি করি”। এস্ট্রেলা প্রফেশনার ব্র্যান্ড নামে বাজারে পণ্য সরবরাহ করে সিওনা কসমেটিকস। বিশ্বমানের পণ্য উত্পাদনের জন্য ইউরোপের গবেষণা কেন্দ্রে গবেষণা করায় সিওনা।

বছর জুন মাসে এঞ্জেল ইনভেস্টমেন্ট তুলেছে কোম্পানিটি। এই আর্থিক বছরেই খুচরো বাজারে নিজেদের পণ্য বিক্রিও শুরু করবে তারা, খুব তাড়াতাড়িই বিভিন্ন সুপার মার্কেটে তাদের পণ্য পাওয়া যাবে বলে জানালেন রাজা।

খুবই সাধারণ পরিবারে জন্ম রাজার। বাবা ছিলেন সরকারি কর্মচারি, রাজার পড়াশোনা মাদুরাইয়ের একটি সরকারি সাহায্য প্রাপ্ত স্কুলে। সিওনা শুরুর ৭ বছর আগে প্রথম নিজের উদ্যোগ শুরুর ভাবনা মাথা চারা দেয়। রাজার কথায়, “সবসময়ই নিজেকে উচ্চতর জায়গায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে, যদি তা যন্ত্রনাদায়ক হয় তবুও। হেঙ্কেল ছাড়ার সময় তারা আমাকে জিগেস করেছিল কী করলে আমি তাদের সঙ্গে থাকব। আমি জানিয়েছিলাম, কিছুই নয় কারণ আমার সামনে তখন অন্য ডাক ছিল, জীবনটা এই যাত্রাটাকে উপভোগ করার জন্য। নতুন কিছু তৈরি করা, মূল্য উত্পাদন এবং সকলকে নিয়ে বেড়ে ওঠা এটাই জীবনটাকে উপভোগ্য করে তোলে।

উদ্যোগের দুনিয়ায় নতুনদের প্রতি রাজার পরামর্শ, “পৃথিবীটা বদলাচ্ছে। প্রযুক্তির ব্যবহার নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। কয়েকবছর আগেও যা অসম্ভব ছিল এখন তা সম্ভব। আপনার যদি কোনো ভাবনা থাকে, এগিয়ে চলুন ও তা বাস্তবায়িত করুন”।

অনুবাদক-সানন্দা দাশগুপ্ত