"কখনও থামতে নেই" বলছেন দৃষ্টিহীন সিএ দিলীপ

"কখনও থামতে নেই" বলছেন দৃষ্টিহীন সিএ দিলীপ

Wednesday February 10, 2016,

3 min Read

দৃষ্টিহীন মানুষ আলো দেখালে তা যে এক অসম সংগ্রামের মাধ্যমে প্রাপ্তি এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। অন্ধজনে দেহ আলোর শুভবার্তা আছে। আবার অন্ধজন শিক্ষার সুযোগ পেলে তিনি যে চষ্ক্ষুমানদের পর্যন্ত আলোকিত করতে পারেন তেমনই একটি দৃষ্টান্ত এ দেশের প্রথম দৃষ্টিহীন চাটার্ড অ্যাকাউন্টটেন্ট বর্তমানে ৫৪ বছরের তরুণ দিলীপ লয়ালকা।

image


দিলীপ লয়ালকা মাড়োয়ারি সম্প্রদায়ের মানুষ। রক্তে ব্যবসা। দিলীপ নিজে চালান নিজের খোলা সিএ কম্পানি। বেশ কয়েকজন কর্মীকে নির্দেশ‌ দিয়ে অফিস চালাচ্ছেন, তাও প্রায় বছর কুড়ি হয়ে গেল। কর্মীরা প্রত্যেকে মালিকের সুন্দর ও ভদ্র ববহারে অফিস পরিবেশটাকে ভাল‌ রাখতে শিখেছেন।

সমাজসেবামূলক নানা ধরণের কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত দিলীপ। তাছাড়া, নিজের পেশা সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি বই আছে। বিভিন্ন আয়কর জার্নালেও নিয়মিত লেখালেখি করেন। নিয়মিত গেস্ট লেকচারার হিসাবে কাজ করছেন একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০০৫ সালে ভারতের তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালামের হাতে পুরস্কৃত হয়েছেন। এর আগে ২০০২ সালে কেন্দ্রীয় সামাজিক ন্যায়বিচার দফতর দিলীপকে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার দিয়েছিল।

খুব ছোটবেলায় দিলীপের দৃষ্টিশক্তির কোনও সমস্যা ধরা পড়েনি। তবে, দশম শ্রেণিতেই পুরোপুরিভাবে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। এরপর স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া চালিয়েছেন শুনে শুনে। মানুষটি শ্রুতিধর। ‌যা একবার শোনেন তার পুরোটা মনে রাখার মতো ক্ষম‌তা ধরেন। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হওয়ার কারণে সিএ-র পরীক্ষা একবারেই পাস করতে পেরেছেন।

মানুষ হিসাবে নিজেকে নিতান্ত সাধারণ ভাবতে ভালবাসেন দিলীপ। আদতে তিনি সমাজের উচ্চবিত্ত মহলের বাসিন্দা। দামি ফ্ল্যাটে থাকেন, দামি গাড়ি ব্যবহার করেন। মেয়েকে সিএ পড়িয়েছেন। বাবার ফার্মেই চাকরি করেন তিনি।

দিলীপ দৃষ্টিহীন। অথচ, তিনি বেজায় পরিশ্রমী। নিয়মিত অফিসে ‌যান। সেখানে সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকেন। তারপর অফিস থেকে বাড়ি ফিরে অল্প জলযোগ এবং অল্পক্ষণ বিশ্রাম। ফের কাজে বেরিয়ে পড়া। নিউ আলিপুরে একটি পেট্রল পাম্পের আউটলেটের মালিক দিলীপ। সেখানে সন্ধ্যা থেকে অনেকটা রাত প‌র্যন্ত থাকেন। গভীর রাতে ঘুমোন। আবার সকালে ভোর ভোর ঘুম থেকে উঠে মর্নিং ওয়াক সেরে স্নানখাওয়ার পরে সারা দিনের মতো বাড়ি থেকে অফিসে বেরিয়ে পড়া।

একজন দৃষ্টিহীন মানুষ হিসাবে সময়কে ভাগ করে কাজে লাগিয়ে দিলীপ জীবনে সাফল্য পেয়েছেন। তিনি মনে করেন, চোখ থাকা না থাকার সঙ্গে দেখাদেখির কোনও সম্পর্ক নেই। আসল চোখ তো ওই মানুষের উদ্দেশ্য। মানুষমাত্রেরই ওটা থাকে মনবুদ্ধির ভিতর। ওই চোখ দেখায় মানুষের ভালো চাইলে।

অন্তরের অন্তর্যা‌মী যেন দিলীপকে দেখিয়েছে, মানু‌ষ উদ্যোগ না নিলে কিছুই হওয়ার নয়। এদিকে বহু মানুষ উদ্যোগ নিতেই ভয় পান। কেননা, ওঁরা অলস। 

দিলীপের এই কথাটা অতি মূল্যবান এ কারণেই ‌যে, তিনি নিজেও একজন প্রতিবন্ধী মানুষ। পৃথিবীর রূপরং তাঁর চর্মচক্ষে ধরা পড়ে না। অথচ, প্রতিদিন তিনিই কত বিভি‌ন্ন রকমের কাজ করেন। আর প্রতিটি কাজে প্রতিষ্ঠিত তিনি। এর ভিতরকার রহস্য জানতে চাইলে দিলীপ বলেন, রহস্য বলতে খুব সাধারণ দুটি বিষয় মনে থাকলেই হয়। একটি হল সততা। দ্বিতীয় কথা ভালোবেসে পরিশ্রম করতে হবে।

দিলীপের কাজের স্বীকৃতি বা পুরস্কারের তালিকাও বেশ লম্বা। প্রতিবন্ধী দুনিয়ায় অসাধারণ একজন মানুষ হিসাবে তাঁকে পুরস্কৃত করেছিলেন মিশনারিজ অব চ্যারিটিজের প্রধান সিস্টার নির্মলা।

দিলীপের দুটি সন্তান। ছেলেমেয়েরা বাবার প্রতি ভীষণই সহানুভূতিশীল। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে দিলীপ একজন সুখী মানুষ। আর তাঁর ভিতরকার সুন্দর বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম একটি হল, অতিথিপরায়ণতা।

দিলীপ জানালেন, পড়াশোনা চালাতে কোনও অসুবিধা হয়নি ওঁর। বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। তাই দিলীপ মনে করেন, সব ক্ষেত্রেই এমন‌ হওয়া দরকার। বিশেষত, প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে। আর তাঁর পরামর্শ এই যে, 

কোথাও থামতে নেই। মানুষকে কেবল এগিয়ে যেতে হয়। মানুষের বাঁচার অধিকারকে জীবনে প্রয়োগ করলে দুর্বিপাকে সামনে আসা তুচ্ছ বাধাগুলিও মানুষকে পিছিয়ে দিতে পারে। জীবনের উদ্দেশ্য কখনই হেরে ‌‌যাওয়া নয়।

কলকাতা শহরে মাড়োয়ারি সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করছেন, সেও প্রায় ২৬০ বছর হয়ে গেল। লয়ালকা পরিবারও কয়েক প্রজন্ম ধরে এই মহানগরীর বাসিন্দা। কলকাতা শহরে বহু মেধাবী ও সফল মানুষ বসবাস করেন। তাঁদের ভিতর অনেকেই প্রচারবিমুখ অথবা প্রচারের আওতার বাইরে।

দিলীপ প্রচারবিমুখ। কম কথা বলেন। তবে, ঈশ্বরবিশ্বাসী দিলীপের তারুণ্য ও কাজ থেকে নিশ্চয়ই শিক্ষা নেওয়া ‌যেতে পারে।‌‌‌‌‌‌‌