শুভদীপের Studio15 ছুঁতে চাইছে, কলকাতার হৃদয়

শুভদীপের Studio15 ছুঁতে চাইছে, কলকাতার হৃদয়

Tuesday June 14, 2016,

4 min Read

একটা সময় ছিল, সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা বাংলার ঘরে ঘরে লক্ষ্মী বাঁধা ছিল। গোলায় ধান, নিকনো উঠোনে চালের গুড়োর আলপনা। ফুল্লরার সুখের সংসারে দুঃখ ছিল বারোমাস কিন্তু দুধে ভাতে থাকার একটা বাসনাও ছিল। ফলে লড়াই করে সাফল্য কেড়ে নেওয়ার প্রয়োজন ছিল না। যত সময় এগিয়েছে, যত বণিকেরা এসেছে, এদেশের মাটি আঁকড়ে রাজা হয়েছে, তত শুকিয়ে গিয়েছে ফুল্লরাদের মুখ। বাঙালি সওদাগরের নৌকাডুবির উপাখ্যান কেবল মাত্র বাংলাদেশের লৌকিক কাহিনিতেই ঘুরে ফিরে এসেছে। বাংলার তাঁতির আঙুল কেটে নেওয়া হয়েছে। কৃষকের ধানি জমিতে নীল ফলানো হয়েছে। দরিদ্র থেকে আরও দরিদ্র হয়েছে বাংলা।

কিন্তু এই জল মাটি বাতাস একটি জিনিস এই অঞ্চলের মানুষকে অফুরান দিয়েছে তা হল সৃজনশীলতা। পৃথিবীর এই ভূখণ্ডেই একমাত্র সব বালক পদ্য লেখে। সব বালিকা প্রেমে পড়লে অঙ্ক খাতায় হৃদয়ের চিহ্ন আঁকে। ওপার বাংলা কিংবা এপার বাংলা কানে কানে কথা বলে, গানে গানে। রবীন্দ্রনাথের গান। নজরুলের গীতি।

গত কয়েকবছর আগেও কলকাতার যৌবন মানে; বইমেলায় তুমুল উৎসাহে লিটল ম্যাগাজিন, গিটার নিয়ে নন্দন চত্বরে মিউজিকে মজে যাওয়া, কবিতার শব্দের খোঁজে বিপন্ন বিস্মিত জীবনে স্নায়বিক বিপর্যয় ডেকে আনার নাম ছিল কলকাতা। চারু মজুমদার বনাম রুনু গুহনিয়োগি। সাদা কালো বনাম রঙিন। ছোটো ছবি বনাম বড় ছবি। শক্তি-সুনীল না জয়-জয়দেব। মৃণাল-তপন-বেনেগল নাকি একাই সত্যজিৎ। তুমুল তর্কে কফি হাউসে ঝড় তুলত সেই কলেজ কাট ক্যাপিটাল। দাস ক্যাপিটাল মুখস্থ বলতেন আবৃতির মত করে কলেজ স্ট্রিটের একটি পাগল। খ্যাপা ষাঁড়ের সিংয়ে লাল ওড়নাটা বেঁধে দেওয়ার হিম্মত রাখত যে কলকাতা সে এখন স্টার্টআপ খোলে।... রাত জেগে স্বপ্ন দেখে ব্যবসা করে গোটা দুনিয়াকে দেখিয়ে দেবে। কলকাতা কী পারে আর কী পারে না। আন্ত্রেপ্রেনিওরশিপ এখন কলকাতায় in thing... কেউ কেউ বলেন স্টাইল স্টেটমেন্ট... কেউ কেউ ভীষণ সিরিয়াস। একেবারে সোলের সেই সিন যেখানে হেমা মালিনী তাঁর এক্কা গাড়ি ছোটাচ্ছেন, চাবুকের পর চাবুক মারছেন ঘোড়ার পিঠে, দাঁত কিড়মিড় করে বলছেন... 'চল ধন্নো... আজ তেরি বাসন্তী কি ইজ্জত কা সওয়াল হ্যায়।' ... দাঁড়াতেই হবে। হবেই।

কিন্তু এই শহরের ক্রোমোজোমে জেগে থাকা কবিতা গান শিল্পকলার বৈশিষ্ট্যগুলি এত প্রবল যে তার সঙ্গে স্টার্টআপের 'লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান' চরিত্রটা কিছুতেই শঙ্কর হচ্ছিল না। এখন ধীরে ধীরে কেমন যেন বদল আসছে। মিউটেশনও বলতে পারেন। অন্যরকম দেখতে হয়ে যাচ্ছে কলকাতা।

সেদিন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখলাম এক অপরিচিত দৃশ্য। ত্রিগুণা সেন হলের ভিতর যে ক'জন শ্রোতা তার ষাট শতাংশই ফটোগ্রাফার। তার মধ্যে বেশির ভাগটাই মহিলা ফটোগ্রাফার। হাতে প্রফেশনাল ডিএসএলআর। 'ছবি আঁকে, ছিঁড়ে ফেলে' গোছের... একের পর এক ছবি তুলেই যাচ্ছেন ওঁরা। সকলেরই বয়স পঁচিশের কম। ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম ওদের একজন দলপতি আছেন... আলাপ হল। শান্ত স্নিগ্ধ এক যুবক। নাম শুভদীপ চক্রবর্তী। ছবি তোলানোটাই ওর কাজ, এটাই ওর স্টার্টআপ। Studio15 এই নামটাই দিয়েছেন সংস্থার। শুরু করেছিলেন একা একাই। ২০১৩ সালে। কলকাতার নিহিত প্রাণ চঞ্চল তারুণ্যের ভিতর ছবি তোলার নেশাটাকে উস্কে দিয়েছেন এই প্রতিভাময় ছেলেটি।

শয় শয় তরুণ তার সঙ্গে খেপে উঠেছে ছবি তুলবে বলে। আলাপ গড়াতেই জানা গেল, যে সে নন, শুভদীপ একজন তরুণ চিত্র পরিচালক। ওঁর শর্ট ফিল্ম বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় রীতিমত মর্যাদা পেয়েছে। কলকাতার হৃদয় ছুঁতে চান শুভদীপ। স্বপ্ন দেখেন কলকাতায় ছড়িয়ে থাকা আবেগ এই শহরের অনুভূতি প্রবণতাই ওর সাবজেক্ট। কলকাতার নিজস্বতাকেই খুঁজে পেতে চান নিজের ফ্রেমে। এই প্রেম! স্যাঁত স্যাঁতে প্রেম নয়। তুমুল তাণ্ডব করা শহরের হৃদয়, মগজ আর আত্মার মিলন প্রত্যাশী এই যুবক।

২০১৩ থেকে ২০১৬ এই তিনটে বছর ধরে তাঁর স্টার্টআপের লড়াইয়ের গ্রাফটা রোমাঞ্চকর। বলছিলেন, 'শুরুতে তো একাই লড়তে হয় এখন যত দিন গড়িয়েছে মানুষ জুটে গেছে। জুড়ে গেছেন অনেক শিল্পী। একের পর এক ফিল্ম তৈরি হয়েছে। নানান সৃজনশীল কাজ হয়েছে আমাদের ব্যানারে। ইউটিউবে দেখা যায় সেই ট্রেলার। কখনও কখনও নিন্দে সমালোচনা যে জোটেনি তা নয়। তবে প্রশংসাও পেয়েছি আমরা অসংখ্য মানুষের। শুধু ছবি নয়। সঙ্গীতও রয়েছে আমাদের ক্যানভাসে। এখন এটা আর আমার একার সম্পত্তি নয়। একা আমার স্টার্টআপ নয়। নিশ্চয়ই অনেক পরিকল্পনা আছে। সেগুলো বাস্তবায়িত করতে হবে আমাকেই তবু ক্যামেরা হাতে নিয়ে যারাই এই শহরকে ফ্রেম বন্দি করতে চান সকলেই এই মঞ্চে স্বাগত।'

একের পর এক ইভেন্ট করছেন ওঁরা, চলছে ছবি তোলার প্রতিযোগিতা, ফিল্ম বানানোর ওয়ার্কশপ আর সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করছেন সেই সব। এই কলকাতার ভিতর থেকে ফুটে উঠছে আরও একটি কলকাতা। যে কলকাতাকে আমরা সকলেই চিনি যে কলকাতা স্বপ্ন দেখতে চায়, স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে কিন্তু তার মধ্যেও সামান্য সামান্য করে বদল হচ্ছে। শুভদীপদের হাত ধরেই পরিচিত শহরের পরিচয় বদলে যাচ্ছে নিশ্চয়ই।