৬০-৭০ এর দশক। চর্তুদিকে ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও স্লোগান। সেই স্রোতে খানিকটা গা ভাসিয়ে দিয়েছিলেন অমল পণ্ডিত। তখন তাঁর ভরা যৌবন। কাউকে পরোয়া করার ইচ্ছে ছিল না। অন্যায় দেখলেই প্রতিবাদের কণ্ঠ উচ্চস্বরে উঠত। ছাপোষা পরিবারে এমন ‘দামাল’ ছেলে থাকলে পরিবার তো অতিষ্ঠ হবেই। তাই অমলবাবুকে নিয়ে চিন্তার শেষ ছিল না অভিভাবকদের। দাদা বিমলকৃষ্ণ পণ্ডিত মনে করলেন ভাইয়ের ‘সুমতি’ বোধহয় ফেরাতে পারেন একমাত্র এসএনবি স্যার। মানে ক্যানিং-এর বঙ্কিম সরদার কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল সুধীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে ভাইকে সঙ্গে করে একদিন কলেজে যান বিমল পণ্ডিত। সুধীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ভাল করে আপাদমস্তক অমলকৃষ্ণ পণ্ডিতকে দেখেন। বলে দেন, বিমল তুই চিন্তা করিস না, ভাইকে এখানে রেখে যা।
ওই রেখে যাওয়ার সিদ্ধান্তই জীবন বদলে দিল। সুধীন স্যারের সঙ্গে একই ঘরে থাকা। সব ব্যাপারে তাঁর খেয়াল আছে, কিন্তু অমলের পড়াশোনা নিয়ে কিছু বলতেন না স্যার। অমলবাবু দেখতেন রোজ কাকভোরে উঠে একটা গেঞ্জি আর লুঙ্গি পড়ে হস্টেলের ঘরে ঘরে চলে যেতেন সুধীন স্যার। পড়তে বসার জন্য সবাইক ডেকে দিতেন। কেউ না পারলে তাকে ওখানেই পড়া বুঝিয়ে দিতেন। কলকাতার সব ছেড়ে সুধীন স্যারের এমন ‘সন্ন্যাস’ ভাবাত অমল পন্ডিতকে। ভাবতেন কী এমন আছে যে এভাবে গোটা জীবন পড়ুয়াদের জন্য দেওয়া যায়। নিশ্চয়ই কিছু পান। অমলবাবুর বাবা রাখালচন্দ্র পণ্ডিত ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। জীবনে যা পেয়েছিলেন তার অনেক কিছুই দিয়ে গিয়েছেন। বাসন্তীতে প্রথম কোনও হাসপাতাল হয়েছিল তাঁর উদ্যোগে। এমনকি প্রথম স্কুলও হয়েছিল তাঁর হাত ধরে। কিন্তুর বাবার মৃত্যুর ঘটনা নাড়িয়ে দেয় ছাপোষা মানুষটাকে। অমলবাবুর কথায়, ‘‘দেখলাম, এত খ্যাতি, যশ, প্রতিপত্তি থাকা সত্বেও মানুষের মৃত্যু কত সাদামাটা। মানুষের জন্য কিছু করতে হলে পথে নামতে হবে। সাতটা রাত ঘুমোতে পারিনি। ভাবলাম কীভাবে এগোব। স্যারকে গিয়ে বললাম আশ্রম করব। উনি এক বাক্যে রাজি। তোর ওখানে ছেলে মানুষ হবে, আর আমি এখানে কলেজে পড়াব।’’ তবে স্যারের হুঁশিয়ারিও তাঁর মনে আছে। কারণ এই কাজ করতে গেলে অনেক ঝড় আসবে। জুটবে দুর্নাম। এসব সহ্য করার ক্ষমতা স্যা রের থেকেই পেয়ে গিয়েছেন তিনি।
সময়টা ১৯৯০। সুধীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের উপস্থিতিতে সূচনা হয় আশ্রমের। বাসন্তীর মহেশপুরে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম অমলবাবু রেখেছিলেন বাবা রাখালচন্দ্র পন্ডিতের নামে। কিন্তু কীভাবে চলবে আশ্রম। বাসন্তীর যশোদা বিদ্যাপীঠে পড়ানোর জন্য পাওয়া বেতন পুরোটা চলে যায় আশ্রমে। যাদের কেউ নেই এমন অনাথ সন্তানদের নিয়েই এই প্রতিষ্ঠান। এরাই অমলবাবুর প্রিয়।
বাসন্তীর কোনও এক জায়গায় এক নবজাতককে কেউ ফেলে দিয়েছিল। অমলবাবু তার নাম রাখেন ‘পথিক’ ওরফে ‘ফেলু’। সেই ফেলু দেখতে দেখতে ৬টা বসন্ত পেরিয়ে গেল। এরকম অনেক ফেলুকেই গ্রামে গ্রামে ঘুরে খুঁজে আশ্রমে নিয়ে এসেছেন অমলবাবু। আয়লার তাণ্ডবে সুন্দরবনের বহু মানুষ এখনও সেই ক্ষতি সামাল দিয়ে উঠতে পারেননি। কেউ কেউ ভাঙা বাঁধের ওপর রাত কাটান। এই বুঝি শেষ আশ্রয়টুকুও গেল। সেখানেও হাজির অমল স্যার। বাড়ির ছেলের পড়ার ব্যবস্থা যে করতে হবে। সুন্দরবনের বাসন্তী ব্লকের বিস্তীর্ণ এলাকার এমনই অনেক দুঃস্থ ও অনাথ শিশু এখন অমল পণ্ডিত-এর ‘আশ্রয়ে’। নিজে অকৃতদার মানুষ হলেও অজস্র ‘সন্তানের’ অভিভাবক তিনি। আবাসিক স্কুল তৈরি করে তাঁদের দুমুঠো অন্নের ব্যবস্থা করেছেন। গত ২৫ বছরে অমলবাবুর এই আশ্রম থেকে প্রায় পঞ্চাশ জন দুঃস্থ-অনাথ শিশু জীবনের পথ খুঁজে পেয়েছেন। কেউ উঁচু পদে সরকারি চাকরি করছেন। কেউ ভাল কীর্তনীয়া হয়েছেন। এই মুহূর্তে তাঁর আশ্রমে রয়েছে ২০ জন পড়ুয়া। যারা স্থানীয় অমলবাবুর বাবার প্রতিষ্ঠিত ষশোদা বিদ্যাপীঠে পড়াশোনা করে।
কলেজ জীবনে সুধীন স্যার প্রতি মুহূর্ত তাঁর আশ্রমে তুলে এনেছেন সদ্য অবসরপ্রাপ্ত এই শিক্ষক। প্রতিদিন সকালে বাচ্চাদের ঘুম থেকে তুলে তাদের মুখ ধুইয়ে পড়তে বসান। পড়ার আগে মুড়ি, বাতাসা বা জল, বিস্কুট দিয়ে টিফিন। এরপর স্নান সেরে সকলেই স্কুলে যায়। আশ্রমের পাশেই আছে প্রাইমারি ও হাইস্কুল। টিফিনের সময় আশ্রমে এসে সকলে ভাত, ডাল, তরকারি বা মাছ দিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে আবার স্কুলে যায়। সেখান থেকে বিকালে ফিরে খেলাধুলা বা গান সেরে সন্ধ্যায় আবার সকলে পড়তে বসে। পুরো বিষয়টি অমলবাবু দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে একাই তদারকি করছেন। তবে এখন বয়স হয়েছে, শরীরও মাঝেমধ্যে দেয় না। তবু হাল ছাড়েননি। ২০ জন পড়ুয়ার সঙ্গে দুজন রাঁধুনির খরচ পেনশনের টাকায় কীভাবে চলবে তা নিয়েও ভাবনা থাকলেও সমাধান হয়ে যায়। গ্রামের কিছু মানুষ অমলবাবুর কাজে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন। কেউ দিয়ে যান ঘরের পটল, কেউ মাছ বা দুধ। গ্রামের মহিলারা খুব অল্প পারিশ্রমিকে আশ্রমের রান্না থেকে ঘর মোছার কাজ করে দেন। সুধীন স্যারের কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রীও পাশে দাঁড়িয়েছেন। দশে মিলে করো কাজের মতোই সব কিছুই এগোচ্ছে। স্থানীয় বাজারে গেলে কেউ খালি হাতে ফেরায় না অমলবাবুকে।
আসলে স্যারের সঙ্গে থেকে অমিল পন্ডিত বুঝেছেন কাউকে উপদেশ দিতে হয় না। নিজের জীবনই পরিচয়। তার আশ্রমের সন্তানরা এমন কিছু ভবিষ্যতে করবে এমন কিছু ভাবেনন না তিনি। আশ্রমে খুলেছেন হোমিওপ্যাথি দাতব্য চিকিসালয়। শুভানুধ্যায়ীদের থেকে পাওয়া সেলাই মেশিন তুলে দিয়েছেন এলাকার মেয়েদের হাতে। তারাও দু পয়সা রোজগার করছে। এত সন্তানের দায়িত্ব। তা বলে তাদের মধ্যে আনন্দ থাকবে না। বাসন্তীর মহেশপুর এলাকা থেকে পাঁচ মাইলের মধ্যে কোনও দুর্গাপুজো নেই। তাই কয়েক বছর ধরে আশ্রমেই হচ্ছে দশভুজার আরাধনা। হয়তো এভাবে অশিক্ষা, অবহেলা নামের অসুরগুলোকে তিনি বাগে আনতে চাইছেন।