ফোর্বসের তালিকায় কলকাতার 'ডানপিটে' কন্যে

ফোর্বসের তালিকায় কলকাতার 'ডানপিটে' কন্যে

Tuesday February 16, 2016,

4 min Read

ফোর্বসের তালিকায় গোটা বিশ্বে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ তিরিশ জন নারীর মধ্যে এক জন কলকাতার। না আপনি যার কথা ভাবছেন তিনি নন। এই মেয়ে স্কলার। ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি-র পিএইচডি। আটাশ বছর বয়স। একটি ড্রোন ক্যামেরা বানিয়েছেন। ভাবছেন তো এ আর এমন কি! কিন্তু এই ক্যামেরা মহাসাগরের তলায় যেখানে জিপিএস কাজ করে না সেখানেও দারুণ চলে। এই আবিষ্কারের কথা জানাজানি হতেই রীতিমত হৈ চৈ পড়ে গেছে। গোটা বিশ্ব কাঁপিয়ে দিয়েছে এই কলকাতার কন্যা। এখন অবশ্য মার্কিন মুলুকই তাঁর ঘর বাড়ি। নাম সম্প্রীতি ভট্টাচার্য। ৩-৪ দিনের জন্য বাড়ি ফিরেছিলেন সম্প্রীতি। ধরে ফেললাম আমরা। ইওর স্টোরির জন্য একটা ইন্টার্ভিউ হাসতে হাসতেই দিয়ে দিলেন এই দুনিয়া কাঁপানো মেয়ে।

image


কেমন ছিল ছোটবেলা, কোথায় থাকতেন, কোন স্কুল? এমন কাণ্ডটা করলেন কী করে?

দক্ষিণ কলকাতায় বড় হয়েছি। সাউথ পয়েন্টে পড়তাম। লোকে বলত আমি নাকি খুব ডানপিটে ছিলাম। হয়ত ঠিকই বলত। বাবা-মা কোনদিন আমার পড়াশুনা নিয়ে পেছনে পড়ে থাকত না। আমার যা ভাল লাগত পড়তাম। যা ইচ্ছে করত, তাই করতাম। ছোটবেলা থেকেই আমার অ্যাস্ট্রোফিজিক্সে খুব আগ্রহ ছিল। বারো বছরে যখন পা দিলাম, আমার হঠাৎ ইচ্ছে হল ‘নাসা’-য় কাজ করতে হবে। যখন ক্লাস টেনে উঠলাম, ডিসকভারি চ্যানেল দেখতে শুরু করলাম। সেখানেই জানতে পারলাম এম.আই.টি বা হাভার্ডে কি ধরনের গবেষণামূলক কাজ হয়। আমার এই সব বড় বড় ইচ্ছের কথা শুনে এমন ভাবার কোনও কারণ নেই যে আমি পড়াশুনায় দারুণ ছিলাম। ক্লাস-টু তে বরং আমি খুব সাধারণ ছিলাম। বেশ মনে আছে, ক্লাস-টু তে সবাই যখন মন দিয়ে প্রাইভেট টিউশন নিতে যেত, আমি ক্লাস পালিয়ে বাড়িতে বসে ‘মিশন মার্স’-এর ওপর স্কুল প্রজেক্ট করতাম যত্ন করে। স্কুলের পরীক্ষায় যা নম্বর পেতাম, স্কুলের শিক্ষকরা বাবা-মা-কে ডেকে বলেছিলেন, এই মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে তেমন আশা না করাই ভালো। আমি তো মনে মনে স্কুল টিচারদের কথাটা বিশ্বাসই করে ফেলেছিলাম। একসময় মনে হত চাকরি পেলেই হল। আর কিছু চাই না।

সাত বছর আগে তখন সবে কুড়ি কি একুশ, কিভাবে সিদ্ধান্ত নিলেন শহর ছাড়বেন?

জয়েন্ট এন্ট্রাসে অনেক পিছনের দিকে ব়্যাঙ্ক হয়েছিল। তাই ভাল কলেজ পাওয়া সম্ভব ছিল না। সেন্ট-টমাস কলেজে চান্স পেলাম। পাশাপাশি বিড়লা-প্ল্যানেটোরিয়ামের কসমোলজির ওপর স্পেশাল ক্লাসেও যোগ দিলাম। খুব বেশি বই পড়তাম না। কিন্তু ফিজিক্স বা টেকনোলজির ওপর কোথাও কোন সেমিনার বা ওয়ার্কশপের খোঁজ পেলেই, ছুটতাম। ফিরে এসে মহাকাশ এবং মহাজাগতিক নানা প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করতাম। খুব আনন্দ পেতাম এসব করে। নিজের ভালো লাগাটা ধরে রাখার চেষ্টা করতাম। পৃথিবীর বাইরের যে ব্রহ্মাণ্ড তাইই আমাকে বেশি টানত। জানার প্রবল আগ্রহ ছিল আমার। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানারকম বই পড়তাম। 

মজার কথা হল আমাকে যে বইটা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করল, সেটা কিন্তু স্টিফেন হকিংয়ের নয়। সেটা হল ঝুম্পা লাহিড়ী-র ‘নেমসেক’। ওঁর বইয়ের কথাগুলো আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। ‘নেমসেক’ পড়েই উদ্বুদ্ধ হই। 

প্রায় পাঁচশো-টা কলেজে ইন্টার্নশিপ করার আবেদন পাঠাই। শিকাগো-র ফার্মিল্যাব (ফার্মি ন্যাশনাল অ্যাকসিলারেটর ল্যাবরেটরি) থেকে ডাক পাই। আর ভাবিনি। পকেটে তিনশো ডলার নিয়ে আমেরিকা উড়ে যাই। ২০১০-এ অল্প কিছুদিনের জন্য ভারতে একবারে ফিরে এসেছিলাম টাটা ইন্সটিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চে ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো হিসাবে। তারপর আমেরিকা ফিরে গিয়ে স্নাতক হিসাবে এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশুনা শুরু করি ওহাইয়ো ইউনিভার্সিটিতে। আমার এম এস রিসার্চ এখানে খুব প্রশংসা পায়। এবং এই প্রশংসাই আমাকে এম.আই.টি তে সুযোগ করে দেয়। ডক্টরেট করার জন্য। চার বছর আগে যা আমি স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি।

ইওর স্টোরি- জলের নিচের ছবি তুলতে পারবে এরকম ড্রোন ক্যামেরা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার চিন্তা মাথায় এলো কিভাবে?

সম্প্রীতি-আমি প্রফেসর হ্যারি আসাদের গ্রুপে যোগ দিয়েছিলাম। প্রফেসর আসাদ হলেন এম.আই.টি-র একজন বিখ্যাত রবোটিক বিশেষজ্ঞ। স্যর ফুটন্ত জল তৈরি করার জন্য ডিম্বাকৃতি একটি রোবট তৈরি করেন। আমি স্যরের ওই গবেষণায় যোগ দিই। কারণ রবোটিক্স আমার খুব প্রিয় বিষয়। রবোটিক্স নিয়ে আমি অনেক কিছু জানতে চাই। তখন থেকেই জলের নিচের যোগাযোগ ব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা করার ব্যাপারটা আমার মধ্যে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।

ইওর স্টোরি- আর ফোর্বসে সম্মান? কেমন লাগছে আপনার?

সম্প্রীতি-বিরাট সম্মান। কোনও সন্দেহ নেই। জীবনে যা কিছু করেছি বা করছি- ভাল লাগে বলে, আনন্দ পাই বলেই করেছি। অন্য কাউকে আনন্দ দেওয়ার জন্যে কিছুই করিনি। কিন্তু আমার কাজে যদি পৃথিবী উপকৃত হয়, যদি গভীর কোন সমস্যার সমাধান হয়-মনে করব সেটাই আমার পুরস্কার।

ইওর স্টোরি- পরবর্তী লক্ষ্য?

সম্প্রীতি- আরও অনেক ধরণের রোবট বানাতে চাই। এমন সব, যা মানুষের জীবনের অদ্ভুত অদ্ভুত সমস্যার সমাধান করবে। ইচ্ছে আছে। সময় পেলে এমন একটা রোবট বানাবো যা আপনাদের যাবতীয় রান্না, বাড়ি পরিষ্কার সব সামলে দেবে। আমাদের উচিত-ই নয়, এইসব সাধারণ কাজে সময় নষ্ট করা।