প্রান্তিকের হাত ধরে আলোয় ফিরছে হারানো শৈশব

প্রান্তিকের হাত ধরে আলোয় ফিরছে হারানো শৈশব

Monday March 27, 2017,

2 min Read

সূর্য উঠতেই শুরু হত সকাল। তারপর ঝুলি হাতে স্টেশন চত্বরে ভিক্ষে। কয়েক মাস আগেও এই ছবি দেখা যেত মেদিনীপুর স্টেশনে। প্রান্তিকের হাত ধরে ওদের অনেকেই আজ সমাজের মূলস্রোতে। আজ ওরা ছবি আঁকে। গান গায়। মেদিনীপুরের জনা দশের কলেজ পড়ুয়ার উদ্যোগে আজ রঙিন ওদের জীবন।

image


সদ্য কলেজে পা রেখেছিলেন প্রজ্ঞা পারমিতা। অষ্টাদশী। দায়িত্ববোধটা আগেই ছিল, আরও বেড়ে গেল কলেজ যাওয়ার শুরু থেকে। কলেজ যাওয়ার জন্য ট্রেনের অপেক্ষায় প্লাটফর্মে দাঁড়াতেই ছেঁকে ধরত একপাল ক্ষুদে। হাত পেতে। এই বয়সে ভিক্ষে করাটা রপ্ত করে ফেলেছিল ভালই। পড়াশুনার বালাই নেই। তাদের রোজগার করা টাকা সংসারের চাল ডাল আনতে লাগে, বলেছিল চিট্টু বিট্টুরা। পারমিতারা আরও জনা দশেক বন্ধু একসঙ্গে দল বেঁধে কলেজ যেতেন। বাচ্চাগুলোর এই দশা কলেজ পড়ুয়া কয়েকজনকে ভাবিয়ে তুলেছিল। সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হয়নি। সেই শুরু পথ চলা প্রান্তিকের।

কলেজ শেষে প্রজ্ঞা পারমিতারা চলে আসেন মেদিনীপুর স্টেশনে। স্টেশন চত্বরেই শুরু হয় পাঠশালা। মাঝে মাঝে খোলা মাঠেও চলে গান, আবৃত্তির পাঠ। ‘প্রথম প্রথম লোকের সমালোচনা শুনতে হয়েছিল। অনেকেই বলেছিল ভিক্ষে করতে শিখে গিয়েছে যারা তাদের দিয়ে আর যাই হোক হাজার চেষ্টা করলেও পড়াতে বসানো যাবে না। টাকা পয়সার জোরও ছিল না।কলেজ যাওয়ার পকেট মানি আর বাবা মায়ের কাছ থেকে অনুরোধ উপরোধে কিছু টাকা ম্যানেজ করা। ওই দিয়ে শুরু করে দিই প্রান্তিক’, তৃপ্তির হাসি প্রজ্ঞা পারমিতার মুখে।

এতদিন তেরঙা ওদের কাছে ছিল বিবর্ণ। আজ জাতীয় পতাকা ওদের কাছে বন্দেমাতরাম। আজ ওরা ছবি আঁকে। গান গায়। আর পাঁচটা বাচ্চার মতোই । ‘দিদিরা এলে খুব মজা হয়। অ আ শেখা হয়েছে। লিখতেও পারি। গান শিখছি। আজকে নাচের ক্লাস আছে, দিদি বলে দিয়েছে’, কদিন আগেও ক্রমাগত ভিক্ষে চেয়ে যাত্রীদের বিরক্ত করে যাওয়া চিট্টুর এখন পড়ায় বড্ড মন জনা দশেক দিদির সৌজন্যে।

শুরুটা সহজ ছিল না । ‘টাকাপয়সার সমস্যা তো ছিলই, সেইসঙ্গে আগ্রহের অভাব ছিল শিক্ষার্থীদেরও। তাদের জন্য বই, খাতা, পেন্সিল, আঁকার সরঞ্জাম মাঝে মধ্যে চকোলেট, বিস্কুট যাই হোক একআধটু খাবার জোগাড় করা চাট্টিখানি কথা ছিল না আমাদের কাছে। চেয়েচিন্তে সেই ধাক্কা সামল দেওয়া গিয়েছে। আগে যারা নাক সিঁটকোতো তারাই এখন আগ বাড়িয়ে সংস্থার ফান্ডে টাকা দেয়। সামান্যই। তবু ওটাও বা কম কী’, শুরুর লড়াইয়ের কথা বলছিলেন প্রান্তিকের আরেক সদস্য সোমা।

দিনভর কলেজে ক্লাস করে ক্লান্ত পারমিতাদের কাছে প্রান্তিক খোলা জানালার মতো। সারল্যেভরা কচিকাঁচাদের মুখে অ আ শুনলেই দিনের যত ক্লান্তি মুছে যায়। গান, নাচ, আবৃত্তি, ছবিআঁকা সবই আছে মস্তি কি পাঠশালায়। সুযোগে বঞ্চিত এই প্রান্তবাসীদের সামনে নতুন একটা দরজা খুলে দেওয়া। একটা অন্য আগামীর স্বপ্ন বুনে দেওয়া ওদের মনে। প্রান্তিকের এটাই চাওয়া। সেই ইচ্ছেপূরণের লক্ষ্যেই এগনো জনা দশেক কলেজ পড়ুয়ার। দুনিয়াকে বদলানো আর নিজেকে বদলে ফেলার সেতুবন্ধনে।