পুরুলিয়ার ‘মন্দিরনগরী’ কেন ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন নয় !

পুরুলিয়ার ‘মন্দিরনগরী’ কেন ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন নয় !

Saturday February 13, 2016,

3 min Read

প্রাচীন জৈনমন্দির থেকে শিলালিপি। পুরাকীর্তিতে সমৃদ্ধ পুরুলিয়ার রঘুনাথপুর মহকুমা। শুধু রঘুনাথপুর নয়, গোটা জেলা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পুরাকীর্তির বহু নিদর্শন। এককথায় বলাই যেতে পারে, পুরাকীর্তির দেশ পুরুলিয়া। হাজার একটা কিস্যা জড়িয়ে আছে এই সব প্রাচীন ইতিহাসের আড়ালে। এত উদ্যোগ এত দিকে। কেউ কি নজর দিচ্ছেন পুরুলিয়ায়। আমরা ঘুরে এলাম কদিন আগেই। দেখলাম পুরুলিয়ার মন্দিরগুলি পড়ে আছে দারুন অবহেলায়। অথচ এই ইতিহাসের যা ধার ভার তাতে এখানেই হতে পারে কোটি কোটি টাকার পর্যটন ব্যবসা। আরও ভালো সংরক্ষণ হতে পারে এই সব পুরাকীর্তির। এই নিয়েই আমরা কথা বললাম বিশিষ্ট প্রত্নতত্ত্ব গবেষক রাজীব বানুর সঙ্গে। রীতিমত ব্রেন স্টর্মিং সেশন। 

ত্রয়োদশ শতাব্দীর পরবর্তীকালে, বিশেষ করে চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে পুরুলিয়া জেলার তৎকালীন নাম মানভূমে তৈরি হয়েছিল বেশকিছু বিষ্ণপুর ঘরানার টেরাকোটার মন্দির। যেমন রঘুনাথপুরের চেলিয়ামা গ্রামে রয়েছে ১৬৯৭ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত রাধামাধবের মন্দির, রঘুনাথপুরে রঘুনাথ জিউ মন্দির। তাছাড়া এই মহকুমার নিতুড়িয়ার গড়পঞ্চকোট পাহাড়ের পাদদেশে দুটি পঞ্চরত্ন এখনও বর্তমান। সবমিলিয়ে পুরাকীর্তি সমৃদ্ধ এই রঘুনাথপুর ঠিকমতো সংরক্ষিত হলে গড়ে উঠতে পারে পুরাকীর্তির অন্যতম সংগ্রহশালা।

image


জেলার অতি প্রাচীন জৈন নিদর্শনগুলির মধ্যে যে কয়েকটি এখনও মাথাউঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে তাদের মধ্যে রঘুনাথপুর ২ নম্বর ব্লকের বান্দাগ্রামের রেখদেউলটির গুরুত্ব ঐতিহাসিক দিক থেকে অনেক বেশি। এই দেউলের সামনেই রয়েছে পাথরের নাটমন্দির। তাছাড়া এই মহকুমার সাঁতুড়ি ব্লকের গাঙপুরে রয়েছে অষ্টাদশ শতকের রঘুনাথমন্দির। পুরাতত্ত্বের একটি বড় নিদর্শন এটি। আবার এই ব্লকের সাঁতুড়িগ্রামের বাগুলিথান, লালগড়ের গুমদা মূর্তি, ভূতনাথমন্দির, ভেটির শিবমন্দিরও উল্লেখযোগ্য পুরাকীর্তি। রঘুনাথপুর ২ ব্লকের গুরুডি গ্রামে দামোদরের জলের নীচে অর্ধেকটা আবার জলের ওপরে কিছুটা। এভাবেই দাঁড়িয়ে আছে তেলকুপি মন্দির। প্রথমে অবশ্য মন্দিরটি জলের নীচে ছিল না। দামোদরের ওপর পাঞ্চেত জলাধার তৈরির পরই এই হাল। প্রায় বারো মাসই মন্দিরের অর্ধেকটা থাকে জলের তলায়।

ছৌ-ঝুমুর রিসোর্স সেন্টারের অধিকর্তা সুভাষ রায় বললেন, এখানে মূলত জৈনদের স্থাপত্য নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। পুরুলিয়া জেলা একদিকে যেমন লোকসংস্কৃতি ভান্ডার, তেমনি অন্যদিকে পুরাতত্ত্বেরও খনি। বিশেষ করে রঘুনাথপুর মহকুমা জুড়ে গ্রামগঞ্জে ঘুরে বেড়ালেই বোঝা যাবে এই মহকুমার ভূখন্ড অতীতের এক বৃহৎ মন্দির নগরী। আনুমানিক অষ্টম থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত এই জেলার বুকে বিরাজ করত প্রস্তর ও ইটের তৈরি বিশাল আকৃতির অজস্র দেব দেউল। প্রতিটি দেউলের অভ্যন্তরে অসামান্য কারুকার্যের জৈন তীর্থঙ্কর মূর্তি অথবা নানান দেব-দেবীর মূর্তি। সেই সব মূর্তির ক্ষয়ে যাওয়া অবশিষ্ট দেখে আজও বিস্ময় জাগে।

‘ঠিক মতো সংস্কার ও সংরক্ষণ করা গেলে প্রত্মতত্ত্বের ভান্ডারে পরিনত হবে পুরুলিয়া, সেই সঙ্গে পর্যটনের অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে রাঢ় বাংলার এই অংশটি’, বলেন রাজীব বাণু। কোথাও কোথাও সঠিক সংরক্ষণের অভাবে হাজার হাজার বছরের পুরনো এই নিদর্শনগুলি নষ্ট হতে বসেছে। তার কারণ হিসেবে রাজীব বলেন, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, ফান্ডিং এবং সরকারি গড়িমসিই দায়ী। 

পুরাকীর্তি নিয়ে তাঁর গবেষণার নানা বিষয় ‘বাংলার প্রত্নতত্ত্ব’ নামে তিনটি খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। চতুর্থ খণ্ডের কাজ চলছে। গবেষণার কাজে সারা বাংলা ঘুরছেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন বাংলা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা নানা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলছেন, প্রত্নতত্ত্বগুলি সংস্কার ও সংরক্ষণের দ্রুত ব্যবস্থা করুক সরকার। না হলে সভ্যতার নিদর্শনগুলি হারিয়ে যাবে। আমরাও হারিয়ে ফেলব আমাদের সভ্যতার মিসিং লিঙ্ক। পাশাপাশি পর্যটনের সুবন্দোবস্ত করা গেলে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে আর্থিকভাবে অন্যতম প্রধান পিছিয়ে থাকা জেলা পুরুলিয়া।